বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৮ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
সাহাবি হজরত আনাস ইবনে মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের রিজিক প্রশস্ত হওয়া এবং নিজের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাওয়া পছন্দ করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’ -সহিহ বোখারি : ৫৯৮৬
আলোচ্য হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। কেননা মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, দয়া ও সহযোগিতার মূলভিত্তি হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নষ্ট হলে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে।
বর্তমান সময়ের পত্রিকার পাতায়, অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক মুসলমানই পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য ও আত্মীয়স্বজনের অধিকার সম্পর্কে একেবারেই অসচেতন। ক্ষেত্রবিশেষ পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও আত্মীয়দের সঙ্গে চরম অমানবিক আচরণ করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে চলছেন। আপন পিতা-মাতাকে পাঠাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। অনেকে আবার পিতা-মাতাকে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছেন, আবার অনেক পিতা-মাতা ছেলেমেয়ে বেঁচে থাকার পরও জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন। আলোচ্য হাদিসের শিক্ষা হতে পারে, এই পাষাণ সময়ের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।
ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক বলতে বুঝায় মা ও বাবার দিক থেকে রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দের। সুতরাং পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা, ফুফু, মামা, খালা এবং তাদের ঊর্ধ্বতন ও নিম্নতম ব্যক্তিবর্গ ও সন্তানরা। এরা সবাই রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়ের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম কারণ বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং তারা (রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়) আল্লাহর বিধান মতে পরস্পর বেশি হকদার।’ -সুরা আহজাব : ৬
কারও মতে আত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে আত্মীয় বলা হয়। সাধারণত রক্ত, বংশ কিংবা বৈবাহিক সূত্র থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী আত্মীয়স্বজনের আলাদা আলাদা অধিকার আছে। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা ওয়াজিব। শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যার নামে একে অন্যের কাছ থেকে অধিকার চেয়ে থাকো এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রেখেছেন।’ -সুরা নিসা : ১
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো, কোনো কিছুকেই তার সঙ্গে অংশীদার বানিয়ো না এবং পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো, যারা (তোমাদের) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, এতিম, মিসকিন, আত্মীয় প্রতিবেশী, কাছের প্রতিবেশী, পাশের লোক, পথচারী ও তোমার অধিকারভুক্ত (দাস-দাসী, তাদের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করো), অবশ্যই আল্লাহতায়ালা এমন মানুষকে কখনো পছন্দ করেন না, যে অহংকারী ও দাম্ভিক।’ -সুরা আন নিসা : ৩৬
হাদিসের আলোকে জানা যায়, কেউ আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলে আল্লাহতায়ালা তার সঙ্গে নিজ সম্পর্ক ছিন্ন করেন। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি রাহমান, আমি রাহেমকে (আত্মীয়তার বন্ধন) সৃষ্টি করেছি। রাহেম নামটিকে আমি নিজের নাম থেকে নির্গত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে, আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব।’ -সহিহ বোখারি
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর আমল আল্লাহ কবুল করেন না। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন পিতা-মাতা। কোরআন-হাদিসের আলোকে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরজ আইন ইবাদত। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বারবার তার নিজের ইবাদতের পর পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলাম মতে, শিরকের পরে ভয়ংকরতম কবিরা গোনাহ হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কঠিনতম কবিরা গোনাহ আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, এরপর পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া।’ -সহিহ বোখারি
পিতা-মাতার সেবাকে নামাজের পরেই সর্বোত্তম আমল বলে ঘোষণা করে নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল হলো- সঠিক সময়ে নামাজ আদায় করা এবং পিতা-মাতার সেবা করা।’ -সহিহ বোখারি
নবী কারিম (সা.) আরও বলেন, ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ -জামে তিরমিজি
হাদিসের সূত্র মতে মাতা-পিতার মৃত্যুর পরেও সন্তানের জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে যায়। সেগুলো হলো- ১. মাতা-পিতার জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা, ২. তাদের কৃত ওয়াদা এবং বৈধ অসিয়তসমূহ পালন করা, ৩. তাদের বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা এবং ৪. তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় এবং সুন্দর আচরণ করা। -আল আদাবুল মুফরাদ
মনে রাখতে হবে, সামাজিক অধিকারে আত্মীয়রা এগিয়ে। মুসলিম হিসেবে অন্যদের যেসব অধিকার রয়েছে আত্মীয়রা তাতে অগ্রাধিকার লাভ করবে। শায়খ আবদুর রহমান বিন আয়িদ এমন ১৪টি অধিকার বর্ণনা করেছেন। যার মধ্যে আছে সালাম আদান-প্রদান, স্নেহ ও সম্মান করা, আনন্দ-বেদনার অংশীদার হওয়া, দাওয়াত কবুল করা, জানাজায় অংশ নেওয়া, পরস্পর হিতাকাক্সক্ষী হওয়া, বিবাদ হলে মিটিয়ে দেওয়া, অনুপস্থিতিতে দোয়া করা ইত্যাদি।
আত্মীয় হিসেবে পরস্পরের ও যেসব অধিকার আছে তার কয়েকটি হলো আত্মীয়রা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে। এমনকি কেউ বিচ্ছিন্ন থাকলেও তার সঙ্গে অন্যরা যোগাযোগ রক্ষা করবে। তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা। আত্মীয়দের মেহমানদারি করা, অবশ্য মেহমানদারি সাধারণ মুসলমানের অধিকার। আত্মীয় হলে তা আরও দৃঢ় হয়। আত্মীয়-স্বজন অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া এবং খোঁজখবর নেওয়া আবশ্যক। এমনকি আত্মীয়ের অধিকার হলো- পরস্পরের জাগতিক কল্যাণ কামনার মতো পরকালীন কল্যাণের ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক করা। অভাবগ্রস্ত হলে সাহায্য-সহযোগিতা করা। অভাবগ্রস্ত আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতার তাগিদ দিয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মিসকিনকে দান করলে শুধু দানের সওয়াব আর আত্মীয়কে সহযোগিতা করলে দুটি সওয়াব দান ও আত্মীয়তা রক্ষা।’ -সুনানে নাসাঈ : ২৫৮২
এভাবে পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের অধিকারের ব্যাপারে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে, যা স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। আধুনিক সভ্যতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি অবহেলা সীমাহীন। ফলে আমাদের মাঝ থেকে শ্রদ্ধা, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা ইত্যাদি লোপ পাচ্ছে এবং পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। অথচ পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজন হক আদায় করা একজন মুমিনের জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে- এ বিষয়টি অনুধাবন করা সবার জন্য একান্ত জরুরি।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com