বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৮ অপরাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
একটা সময় পর্যন্ত একুশ বলতে মনে করা হতো বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের একুশকেই। একুশ দিয়ে আরেকটি ডেটলাইন যোগ হয় ২০০৪ সাল থেকে। সেটি একুশে আগস্ট। যা একদিকে বিয়োগান্ত, আরেক দিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমঝোতা বা ন্যূনতম বিশ্বাসের কফিনে ঠোকা শেষ পেরেক। বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনের কেক কাটা স্থগিত রেখে মিলাদ আর দোয়ায় পনেরো আগস্টের শোকের আবহ মেনে নিলেও একুশ আগস্টের দায় এড়ানোর কোনো ফাঁকই রাখেনি বিএনপি।
বরং, অন্তত চুপ না থেকে এখনো আগ বাড়িয়ে একুশ আগস্টের বর্বর-বিয়োগান্ত ঘটনার দায় অস্বীকারের মাধ্যমে বিরোধকে আরও পোক্ত করে চলছেন দলটির কোনো কোনো নেতা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তখন ‘ওই ঘটনা আওয়ামী লীগই ঘটিয়েছে, গ্রেনেড শেখ হাসিনার ভ্যানিটি ব্যাগেই ছিল’ ধরনের মন্তব্যের পরও থামার দরকার মনে করেননি তারা। ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ বা নিজেদের দায়িত্বের ব্যর্থতা শিকার তো আরও পরের বিষয়। জজ মিয়াসহ নানা নাটক এবং পারলে শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নেতাদেরই দোষী সাব্যস্ত করে ফেলা হয়।
ভয়াবহ সন্ত্রাসী ওই হামলার শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলীয় নেতাকর্মীরা মানববর্ম রচনা করে তাকে রক্ষা করলেও গ্রেনেডের আঘাতে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। গ্রেনেডের যন্ত্রণা ও ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন অনেকে। প্রথমে গ্রেনেড হামলার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হয়নি। বলা হচ্ছিল তাদের ব্যর্থতা-দায়িত্বহীনতার কথা। অল্প সময়ের মধ্যে ওই সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার নমুনা মিলতে থাকে, যা পরে বিচারের রায়েও প্রমাণ হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এ দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে কলঙ্কিত গ্রেনেড হামলার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা শিকার পর্বেও যায়নি সরকার। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর আলামত না দেখে তখনকার আওয়ামী লীগ সন্দিহান হয়ে পড়ে। উপরন্তু বাহিনীর সদস্যদের ব্যস্ত করে দেওয়া হয় ঘটনার আলামত নষ্ট করাসহ কল্পকাহিনির স্ক্রিপ্ট তৈরির কাজে।
বেঁচে যাওয়া ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বছর বছর ইতিহাসের জঘন্যতম গ্রেনেড হামলার বার্ষিকী পালন করেন, আর ফোঁসেন। তাদের কাছে এটি ‘নিপীড়িত হওয়ার বর্ষ’। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর ওই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া, স্পিøন্টারের আঘাতে হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার ঘটনা তাদের চোখে ভাসে। এখনো আতঙ্কে ফেলে। যার অনিবার্য জেরে সংলাপ-আলোচনা-সমঝোতার কথা শুনলে তারা চটেন। মিলমিশ-সমঝোতার আহ্বান তাদের কাছে কাটা ঘায়ে নুন ছিটা দেওয়ার মতো। কারা, কেন ঘটনা ঘটিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া কারও জন্য ওই ঘটনার হোতাদের সঙ্গে সমঝোতা-সংলাপের আহ্বান আরও তাড়না দেয়। পরিহাসের মতো লাগে। চলমান বিরোধ মেটানো বা রাজনৈতিক সমঝোতার পথে একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলা অবশ্যই অন্যতম বড় বাধা। আক্রান্তরা তো নিশ্চিত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যেই চালানো হয়েছিল হামলাটি।
নানা পর্ব শেষে ২০০৮ সালে আদালতে দেওয়া দুটি অভিযোগপত্রে বিএনপি সরকারের একজন উপমন্ত্রী, তার ভাইসহ ২২ জনকে এ ঘটনার জন্য আসামি করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে অধিকতর তদন্ত হয়। এ তদন্তের পর আসামি করা হয় বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও ত্রিশজনকে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় হয়। আদালত গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার দায়ে বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে পলাতক তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে ১১ আসামির।
বিএনপির তরফ থেকে বরাবরই এগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা হচ্ছে। অর্থাৎ ঘটনাটি দেশের বৃহৎ দল দুটির বিরোধকে কেবল আরও জোরালো নয়, একেবারে স্থায়ী করে দিয়েছে। যেনতেন বুঝজ্ঞান বা মলমে এ ব্যথা-বিরোধ সারানোর মতো নয়। তারা পরস্পরকে কেবল শত্রু ভাবতেই শৃঙ্খলিত করে নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রশাসনের ওপরই গ্রেনেড হামলার দায় বর্তায়। তারা ওই দায় মোচনের চেষ্টা হিসেবে দুঃখপ্রকাশ বা অন্তত ভর্ৎসনার কাজটিও না করে উপরন্তু আক্রান্তদেরই দোষী সাব্যস্তের চেষ্টা করেছেন। তা কেবল রাজনীতির নয়, রাষ্ট্রের কাঠামোকেও তছনছ করে দিয়েছে।
দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে প্রাথমিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের দায়িত্ব। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো এত বড় অপরাধ যারা করেছিল, তাদের চিহ্নিত করা, গ্রেপ্তার করা এবং আইনের হাতে সোপর্দ করার জরুরি কর্তব্যটি তৎকালীন সরকার সম্পাদনে কেবল চরমভাবে ব্যর্থতারই পরিচয় দেয়নি; বরং ঘটনাপ্রবাহ অন্য খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
বিএনপি সেই প্রশ্নের তীর থেকে আজও নিস্তার পায়নি। ভুক্তভোগী দল আওয়ামী লীগের কাছে তা কত নির্মম-বেদনার জানে কেবল তারাই। এখনো মাঝেমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে ২১ আগস্ট নিয়ে যে ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়, সেটা আওয়ামী লীগের ক্ষোভ ও ক্ষুব্ধতায় প্রলেপ দেওয়ার মতো নয়। বরং কষ্টকে আরও উসকে দেয়। ২১ আগস্টের ঘটনাকে সামনে এনে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিএনপির রাজনীতি করার অধিকারই নেই। এমনকি কেউ কেউ বিএনপিকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি পর্যন্ত করেন।
মর্মান্তিক ঘটনাটির রেশ রাজনীতির বাইরের মানুষকেও আর কত দিন ও কীভাবে টেনে যেতে হবে? দুটি রাজনৈতিক দলের বিরোধ অরাজনৈতিকদেরও খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের শিকার তারা। এখানে ক্ষত নিরাময়ের ক্ষেত্র খোঁজা বড় কঠিন। নৃশংস ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় একদলকে বেশি, আরেক দলকে কম দায়ী করে পিঠ চুলকানির মতো মোড়লি সালিশে তাদের মিলিয়ে দেওয়ার অবস্থা এখানে নেই। আক্রান্ত দলটির মতো সাধারণ শ্রেণির অনেকেও একুশে আগস্টের হামলার বিষয়টিকে নিছক একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ভাবতে পারে না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে বিরোধের পেছনে অন্যতম দুই তারিখ ও কারণ পনেরো আগস্ট ও একুশে আগস্ট। দুটি বিশেষ তারিখ বা ঘটনায় কেন রাজনীতির পথ আটকে থাকবে এ প্রশ্নের জবাব মেলাও কঠিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট অভিশপ্ত তারিখ দুটি ক্যালেন্ডার থেকে তুলে দেওয়াও সম্ভব নয়।
রাজনীতির গতিপথে বিরোধ, ভিন্নমত, মতপার্থক্য স্বাভাবিক হলেও হত্যা-বিনাসের মানসিকতা অস্বাভাবিকতাকেই কেবল বাস্তব করে তুলছে। মত ও পথের ভিন্নতা সম্প্রীতি ও সৌহার্দের পরিবেশ যে মাত্রায় নষ্ট করেছে তা অনেকটা ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবো কোথায়’র মতো। একুশে আগস্টের গ্রেনেড বাংলাদেশের রাজনীতিকে সেই ব্যথায় কাতরিয়ে ছাড়ছে। রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত দল বিএনপির মধ্যে অতীতের ভুল শুধরানোর রাজনৈতিক কৌশল অস্পষ্ট। আত্মসমালোচনাও নেই।
ভবিষ্যতে বিএনপি তার সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে ক্ষমতায় গেলে দেশে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির চর্চা বন্ধ করবে কি না, সে কথা স্পষ্ট করছে না। বরং সুযোগ পেলেই হুমকি-ধমকিতে চারদিক আরও উতলা করে দেওয়া হয়। ঘুরে দাঁড়াতে হলে তাদের রাজনীতিতে পরিবর্তনের বার্তা দিতেই হবে। একুশে আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার দায় স্বীকার-অস্বীকারেও এখন আর তেমন কিছু যায় আসে না। তবে পনেরো আগস্ট ট্র্যাজেডির তারিখে কেক কাটা বন্ধ করে বেগম জিয়ার জন্মদিনে দোয়া-মোনাজাতের বিলম্বিত সিদ্ধান্ত দেশের রাজনীতির বিরোধের ব্যথায় কিছুটা হলেও মলম ফেলেছে। একুশে আগস্ট নিয়ে কী করা যায় বা তারা করতে পারে তা ঠিক করতে হবে বিএনপিকেই। যা হতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠের সহাবস্থান-সমঝোতা তথা অন্তত আলোচনা-সমঝোতাসহ মুখ দেখাদেখির দাওয়াই।
ভয়েস/আআ