বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

আজ্ঞাবহ রওশন ও কাদেরের গরম বক্তৃতা

মোস্তফা কামাল:

এবার ক্ষমতার মেইন স্ট্রিমের হকদার হতে চায় জাতীয় পার্টি। দেবর-ভাবির মধ্যে বিরোধ থাকলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভাগযোগে ক্ষমতার উল্লেখযোগ্য হিস্যা চায় দুগ্রুপই। যার যার কৌশল ভিন্ন, লক্ষ্য অভিন্ন। জিএম কাদের জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের গরম বক্তৃতা দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেছেন দিল্লি সফরে। তিনি আর তার স্ত্রী শেরীফা কাদেরই জাপা। তারাই ভারত সফরে জাপার প্রতিনিধি। এর আগে, রওশন এরশাদ দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। রওশন প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে এসেছেন তার অধীনে নির্বাচনের থাকার কথা।

আদতে ক্ষমতার মোহ কাদের-রওশন দুজনেরই। সেই মোহ থেকেই দলে বিভক্তি। বাদ বাকি নেতাদেরও তারা তাদের মতো অভ্যস্ত করে নিতে পেরেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে জিএম কাদের বেশ কিছুদিন ধরে কঠোর-বিপ্লবী বক্তব্য রাখছেন। নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ বিদেশি দূতদের সঙ্গেও তিনি দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ নির্বাচন আয়োজনে জাতীয় পার্টির অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ করার এ চেষ্টায় তিনি নিজের একটা অবস্থান তৈরিতে অনেকটা সফল।

রওশন এরশাদ শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্বাচন চান। অন্যদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবি করলেও নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে জিএম কাদেরের জাপা কোনো কথা বলছে না। তবে আরও বেশি আসনে ক্ষমতার শরিকানা চান, বিশেষ বোঝাপড়ায় বিরোধী দল হতে চান, তা পরিষ্কার। যা রওশন এরশাদেরও চাওয়া। ভারত ভ্রমণের আগের বক্তব্যে বড় ভাইয়ের সম্পত্তি আয়ত্ত করে রাখা জিএম কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ দেশকে পারিবারিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে। নির্বাচন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও জাপার সমস্যা একই। জাপার অবস্থা আওয়ামী লীগের চেয়েও করুণ। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জাপার রংপুর এলাকার কয়েকটি আসন ছাড়া দেশের আর কোথাও কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বোঝাপড়া ছাড়া তাদের গতি নেই। আর সেখানে সেতুবন্ধ হচ্ছে ভারত। তাই ভারতকে আয়ত্তে রাখার বিষয়-আসয় রয়েছে। যা নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা রওশন-কাদের দুগ্রুপে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার নামে সম্প্রতি বরিশালের বাকেরগঞ্জে একটি সড়কের নামকরণ করেছেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নাসরিন জাহান রতœা ও তার স্বামী দলের কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। হর্ষবর্ধন শ্রিংলার নামে সড়কের নামকরণ সম্পর্কে জানেনই না সেখানকার ইউএনও। অথচ, রাস্তার নামকরণের ক্ষেত্রে উপজেলা কমিটি থেকে প্রস্তাব যেতে হয়। আর বিদেশি কারও নামকরণের ক্ষেত্রে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এখানে সেসব নিয়মের কোনোটাই মানা হয়নি। রতœা এবং হাওলাদার জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে রওশন এরশাদ গ্রুপের।

আওয়ামী লীগ, সরকার, তথা ভারতের আস্থাভাজন হওয়ার দৌড়ে রওশন এরশাদ ও তার গ্রুপের কর্মতৎপরতা ওপেন সিক্রেট হলেও জিএম কাদেরের ভূমিকা চাতুরিতে মোড়া। ভারত সফরে যাওয়ার আগে কয়েকদিন সরকারের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য ছিল অত্যন্ত জ্বালাময়ী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ করে তিনি বলে গেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করতে পারে না। তারা ভোটাধিকার হরণ করেছে। মানুষের বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই শাস্তি পেতে হয়। মানুষের ভোটাধিকার থাকলে, তাদের একনায়কতন্ত্র কখনো স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হতো না। তারা মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা যুদ্ধ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র অথরিটি আওয়ামী লীগ নয়।’

জিএম কাদেরের সরকারবিরোধী গরম বক্তৃতা আর রওশন এরশাদের সরাসরি সরকারের আজ্ঞাবহতা উভয়েরই উদ্দেশ্য আসন ভাগাভাগিতে বেশি শরিকানা হাসিল করা। নির্বাচন সামনে রেখে দলকে একটি ফ্যাক্টর হিসেবে সামনে আনার এজেন্ডা থেকেই তাদের সাম্প্রতিক এসব বক্তব্য ও যাতায়াত। কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছে, কেউ ভারতে। ভোটের অঙ্কে জাপা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হলেও রাজনীতিতে কোনো স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে পারেনি। কোনো না কোনোভাবে তারা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে জাপা দুর্বল হয়েছে বলে বিভিন্ন সময় দলটির নেতারাও স্বীকার করেছেন। জাপাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি বড় কৌশল ছিল এরশাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো। দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে হত্যা বা দুর্নীতির কোনো মামলা নেই। সে ক্ষেত্রে এরশাদের মতো তার জেলভীতি থাকার কথা নয়। তবে দলটির মধ্যে ভিন্ন দুটি ধারা বা নেতাদের মধ্যে ‘বিরোধ’ রয়েছে। এ রকম অবস্থায় ‘ভয়’ বা ‘প্রলোভনের’ ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাপা স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে।

সচরাচর গণঅভ্যুত্থানে কোনো স্বৈরশাসকের পতনের পর তার আর রাজনীতিতে ফেরত আসার সুযোগ হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদ এর ব্যতিক্রম। পতনের পর এরশাদ কারাবন্দি থাকলেও তার দল ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে ৩৫টি আসন পায়। কারাবন্দি থেকে তিনি নিজেও ৫টি আসনে জয়ী হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। বিএনপি সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে ৪০টির বেশি মামলা হয়। এ আমলের পুরোটা সময় এরশাদকে কারাগারেই থাকতে হয়। বিএনপি আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের অন্যতম শরিক হয় জাপা-জামায়াতও। তখন এরশাদ বা তার জাতীয় পার্টি আর স্বৈরাচার নয়। জামায়াতও রাজাকার নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে জাপা ৩২টি আসন পায়। দলটির সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ‘ঐকমত্যের সরকার’ গঠন করে। সেই সরকারে জাপা থেকে মন্ত্রী করা হয়। আওয়ামী লীগ আমলে এরশাদ একের পর এক মামলায় জামিন পান এবং ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি কারামুক্ত হন। আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে বিরোধী দলগুলো নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোটে শরিক হন এরশাদ।

ওই জোটে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে জাপায় ভাঙন দেখা দেয়। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাপা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তৈরি করেন জাতীয় পার্টি-জেপি এবং নাজিউর রহমান মঞ্জুর বানান বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি। একপর্যায়ে এরশাদের জাপা চারদলীয় ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে যায়। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন জিতে ক্ষমতায় আসে। এরশাদের জাপা ১৪টি আসন পায়। এত মামলা মাথায় নিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকতে গিয়ে এরশাদকে আজ এদিকে, কাল সেদিকে করতে করতেই জীবন সাঙ্গ করতে হয়েছে। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ২৩০টি আসন পায় মহাজোট। মহাজোটের শরিক দলগুলো পায় ৩২টি আসন। এর মধ্যে জাপা পেয়েছিল ২৭টি আসন।

কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার স্বাদ ছাড়া থাকেননি এরশাদ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এসে আবার নাটকীয়তা। প্রথমে নির্বাচন বর্জন, পরে ‘অংশগ্রহণের এ নাটকীয়তায় দৃশ্যপটে হাজির হন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ২১ ঘণ্টার এক সফরে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর এরশাদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তাকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বলেছেন। সুজাতা সিং ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগেই এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানান। কয়েক দিনের মধ্যেই এরশাদ আবার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে। নির্বাচন পর্যন্ত তাকে হাসপাতালেই রাখা হয়। স্বামীকে আটক বা হাসপাতালে রেখে পার্টির স্টিয়ারিংয়ে তখন রওশন এরশাদ।

তার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভাগ্য খুলে যায় জাপার কিছু নেতার। ওই নির্বাচনে ভোটের আগেই ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। একতরফা নির্বাচনটিতে আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪টি আসন পায়। জাপাকে দেওয়া হয় ৩৪ আসন। ২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাপা সংসদে বিরোধী দল হয়। একই সঙ্গে দলটি থেকে মন্ত্রীও করা হয় এবং এরশাদকে বানানো হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট ২৮৮ আসন পায়। মহাজোটের শরিক হিসেবে ২২টি আসন পেয়ে জাপা আবারও বিরোধী দল হয়। এরশাদ হন বিরোধীদলীয় নেতা। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর জাপায় এরশাদের স্ত্রী ও ভাইয়ের বিরোধ। মাঝে ঝলক বা চমক দেখানোর ব্যর্থচেষ্টা তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদের। মূল দলে ভাই জিএম কাদের চেয়ারম্যান হিসেবে নেতৃত্বে এলেও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। মাঝেমধ্যেই তাদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধের এবারের ঝলকের ‍মূল বিষয়ও ক্ষমতার চৌহদ্দি নিশ্চিত করা ছাড়া আর কিছু নয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION