বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪৭ অপরাহ্ন
শতদল বড়ুয়া :
আমাদের হাজারো সমস্যার মধ্যে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি অন্যতম। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দেশে ১১ জুলাই ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালিত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে নানা নির্দেশনা জারি করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এ দেশে বিভিন্ন এনজিও সংস্থাও জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের জন্য সুখবর হলো, দেশের মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। জানা গেছে, ১৯৬০ সালে এ ভূখণ্ডের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র এক কোটি, যা বর্তমানে অনেক গুণ বেড়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ১৯৮৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে পৌঁছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য সামনে রেখে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালন করে আসছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৮০৪ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। এর দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছে প্রায় ১২৩ বছর। ১৯২৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ কোটিতে। এরপর ৩২ বছর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৩০০ কোটিতে। ১৯৭৪ সালে অর্থাৎ ১৫ বছর পর বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৪০০ কোটিতে। ৫০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আরও কম। মাত্র ১৩ বছরে ১৯৮৭ সালে জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে বৃদ্ধি পায়। প্রতি ১২ বছরে বিশ্বে জনসংখ্যা বেড়েছে ১০০ কোটি করে। ১৯৯৯ সালে ৬০০ কোটি। ২০১১ সালে ৭০০ কোটি। সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বরে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায়, প্রায় ৮০০ কোটিতে।
এভাবে বিশ্বে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই জনসংখ্যা বেড়ে ১০০০ কোটি অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়াতে সমস্যার বেড়াজালে আমরা আটকে যাচ্ছি, জনসংখ্যা বানের পানির মতো বাড়ার কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেশ উদ্বেগজনক। বিবিসি ও ইউএনএফপির প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হলো ‘ঢাকা’।
জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে খাদ্যাভ্যাস ও অপুষ্টির কারণে। সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা ও ওজন স্তরের ধ্বংসসহ বহু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব। তার ওপর ঘাড়ে চাপছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। উল্লিখিত সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে একমাত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি।
সরকারের একক প্রচেষ্টায় এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা যাবে না। দিবস পালনের সুফলও সুদূর পরাহত। যেখানে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে আগে সেই স্থান চিহ্নিত করতে হবে। ওই এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সুফল-কুফল বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে। আলোচনায় শামিল করতে হবে সাধারণ জনগণকে। শহরের বস্তিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত। কারণ এরা অশিক্ষিত। নিম্নশ্রেণির মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে বিশ্বাসী নয়। তারা এ পদ্ধতিকে সহজভাবে মেনে নেয় না, গুরুত্বও দেয় না। দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে না আবাদি জমি। বাড়ছে পরিবারে সদস্য সংখ্যা, বাড়ছে না আয় রোজগার। বাড়ছে প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দাম। আয়-ব্যয়ের তাল মেলানো যাচ্ছে না। জিনিসপত্রের দাম সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বদৌলতে আগের চেয়ে বর্তমানে মৃত্যুহার অনেক কমে গেছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারব- মৃত্যুহার কমেছে ঠিকই, জন্মহার বেড়ে গেছে। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে দৈনন্দিন জীবনে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা নিঃস্বার্থভাবে মাঠে-ময়দানে কাজ করছে। অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এ বিভাগের পরিবার কল্যাণ সহকারীরা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে সমাজের সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজে এখনো বেশকিছু কুসংস্কার রয়েছে। কুসংস্কার দূর করে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পরিকল্পনা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালালে হয়তো এর সুফল আগামী প্রজন্ম পাবে। নতুবা সব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আমাদের এগোতে হবে একটা বিষয় নির্ধারণে। আর সেটি হলো ‘পরিকল্পিত পরিবার’। এ সময়ে পরিকল্পিত পরিবারের কোনো বিকল্প নেই।
পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে সম্প্রতি কিছু নিয়মকানুন সৃষ্টি হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। পরিবার পরিকল্পনা সহকারীরা যার যার এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে পৌঁছে নিজের ছবি তুলে নির্দিষ্ট গ্রুপে দিতে হবে। অফিসাররা এগুলো মনিটরিং করে। কোনো কর্মী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেনো ছবি পোস্ট করল না তা জানতে চায় সংশ্লিষ্ট অফিসাররা। এভাবে যদি কর্মীদের দায়িত্ব পালন করতে হয় তাহলে তাদের মনমানসিকতা কোন পর্যায়ে থাকতে পারে, তা ভাবার বিষয়। কর্মীরা কলুর বলদের মতো মাঠে কাজ করবে সারাদিনমান। আবার কর্তাদেরও হাজিরা দেখাতে হবে, স্ব-স্ব এলাকায় পৌঁছে সাড়ে ৯টার মধ্যে নিজের ছবি পোস্ট করে! এভাবে হলে নারীরা নিয়ম পালনে অধিকতর মনোযোগী হবে না।
সম্ভবত পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের নারী কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন তেমন করেন না সংশ্লিষ্ট অফিসাররা। যে কোনো কাজে উৎসাহিত করা গেলে সন্তোষজনক আউটপুট আসে। কর্মক্ষেত্রে তাদের মানসিক চাপে রাখলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে নিশ্চয় ব্যাঘাত ঘটবে। সরকারের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সমস্যা হতে পারে। বিজ্ঞজনদের অভিমত, বর্তমান ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
ভয়েস/আআ