বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০৮ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

লেখাপড়া করে যে…

উম্মে রায়হানা:
লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে এমন আপ্তবাক্য আমরা সবাই শুনে বড় হয়েছি। পড়ালেখার উদ্দেশ্য টাকা রোজগার করা, নাকি মানবিক মানুষ হওয়া, সচেতন হওয়া! আবার নারীর জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা কি ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’র মাধ্যমে পুরুষের নিপীড়ন বা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামোগত বৈষম্য ঠেকানোর অস্ত্র কিনা- তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে। মোট কথা এটা অনেক কিছুর ওপরই নির্ভর করে ও বদলায়, প্রত্যেকের কাছে সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব আলাদা। কিন্তু এই পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে ব্যবস্থা খোদ মানুষকে বিচার করে শ্রমিক হিসেবে। ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার উপার্জিত অর্থের ভিত্তিতে, তার ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে। পড়ালেখা করে এই অর্থ-ক্ষমতা-সম্মান অর্জনের একটা নিশ্চিত উপায় সরকারি চাকরি করা। এ দেশের শহুরে মধ্যবিত্তের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। নগরবাসী অনেকেরই ঊর্ধ্বতন তৃতীয় প্রজন্ম ছিলেন গ্রামে। আমরা যারা মধ্যবিত্ত হিসেবে বড় হয়েছি, এখনো বন্ধুর বাড়ি গেলে বন্ধুর বাবা-মায়ের কাছে যেসব প্রশ্ন শুনতে হয় তার একটা হচ্ছে, গ্রামের বাড়ি কোথায়? তুলনা করতে গেলে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ বরং অনেক বেশি নগরবাসী। কেননা গ্রামের বাড়ির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে ভূমির মালিকানার। ভূমিহীন ভাসমান মানুষেরা ভাগ্যের অন্বেষণে নগরে এসেছেন অনেক আগে। ঢাকার রিকশাচালক ও বুয়াদের মধ্যে অনেকেই জন্মেছেন ঢাকার কোনো বস্তিতে। নগরের চাকা ঘুরতে অনেক শ্রমিকের শ্রম ও ঘাম প্রয়োজন হয়। আবার এই ঘনবসতির দেশে শহরের বাড়ির ভাড়া জোগানোর সংগ্রাম এ দেশের মধ্যবিত্ত মাত্রেই হাড়ে হাড়ে জানেন। আবাসন ব্যবস্থাওয়ালা সরকারি চাকরির জন্য মোহ তাই হয়তো খুব অসঙ্গতও নয়।

বিসিএস চেষ্টা করা, পাওয়া বা না পাওয়া খুবই সাধারণ নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু আজকাল নিউজ মিডিয়ার ব্যাপক কভারেজ দেখলে মনে হয় বাংলাদেশে সরকারি কর্ম কমিশন বিষয়টা নতুন প্রচলন হয়েছে। বিসিএস বিষয়ক খবরাখবর এত বেশি সংখ্যায় এবং এত যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করতে এর আগে কখনই দেখিনি। উদাহরণ দিচ্ছি স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বিসিএস পেয়েছেন এটা একটা ফিচার স্টোরি হতে পারে। কিন্তু চাওয়ালা বা ফেরিওয়ালার ছেলে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সফল হয়েছেন এ ধরনের ঘটনা অভিনব বা চমকপ্রদ হিসেবে নিউজের মর্যাদাই পাচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষাকে আর্থ-সামাজিক বিন্যাসে ওপরের শ্রেণিতে উত্তরণের হাতিয়ার হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের ঘটনা খবর হিসেবে আসায় তেমন কোনো সমস্যা নেই। এ ধরনের স্টোরিগুলোকে বিবেচনা করা হয় অনুপ্রেরণার গল্প হিসেবে, পজিটিভ নিউজ হিসেবে। কিন্তু এসব নিউজ মাত্রাতিরিক্ত প্রকাশ করার প্রবণতাটা খেয়াল করার মতো। বিশেষত একটা খটকা কিছুতেই দূর হচ্ছে না আমার। তা হচ্ছে, যেখানে সরকারি চাকরিজীবীদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারেও এত রকম বাধা নিষেধ থাকে সেখানে হবু সরকারি কর্মকর্তাদের এত সব ব্যক্তিগত তথ্য এবং পারিবারিক ইতিহাস ধরে ধরে নিউজ হচ্ছে, ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক না!

যাদের রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা, সবজিওয়ালা, চা বিক্রেতা, বুয়া, হকার এমন পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে গল্পগুজব করার অভ্যাস আছে তারা জানেন, অনেক সময়ই শ্রমিক শ্রেণির এসব মানুষের সন্তানদের শিক্ষাগত যোগ্যতা শুনে চমকে ওঠে আমাদের মধ্যবিত্ত মন। আবার যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্তরিক যোগাযোগ রাখেন, তারাও জানেন কত ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সন্তানরা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। কিন্তু রিকশাচালক বা হরিজনদের ছেলেমেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, এমন নিউজ দেখিনি। নিউজ তখনই হচ্ছে, যখন এমন কেউ বিসিএস কোয়ালিফাই করছে। এসব অনুপ্রেরণার গল্পগুলো একই সঙ্গে এই মেসেজও দেয়, দারিদ্র্য কোনো সমস্যা নয়, পরিশ্রম করলেই উত্তরণ সম্ভব, যে তা পারছে না সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, সিস্টেমের মধ্যে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। এসব স্টোরি পুরো সিস্টেমের ওপর কেমন জানি একটা মহাত্ম্য আরোপ করে যে, শ্রমিক শ্রেণির সন্তান বলে কোনো বৈষম্য করছে না, গরিবের বাচ্চাকেও বিসিএস ক্যাডার হতে দিচ্ছে!

আমাদের দেশের অবস্থা এখন এমন যে, সরকারি চাকরিতে গাড়িঘোড়া চড়া ছাড়াও ভবিষ্যতের নানা নিশ্চিত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো বিদেশে পড়তে চলে যায়, পড়াশোনা শেষ করে ওখানেই কাজ করে, আর কোনোদিন ফিরে আসে না। যারা যায় তারা নিজেদের ও সন্তানের সুখী, সুস্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই যায়। ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্র্যান্ট নাগরিক হয়েও (অনেক সময় রেসিজমের শিকার হয়েও) বেশির ভাগ মানুষ বিদেশেই থেকে যেতে চায়, নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে সেবা দেয় অন্যের দেশকে। আসলে দেশের আইডিয়াটাই এখন আর তেমনভাবে কাজ করে না, মেধাবী মানুষ মাত্রই বিশ^নাগরিক। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিসিএসকে মহিমান্বিত করে মেধাবীদের আকর্ষণ করার প্রয়োজন হয়। বিসিএস দিয়ে মাপা হয় সাফল্য আর ব্যর্থতা। সরকারি চাকরি করা সম্মানের বটেই, কিন্তু এমন মহান কিছুও তো নয়! সরকারি চাকরি করার সুযোগ পাওয়াকে বিশাল অর্জন মনে করার ধারণা লোককে গেলানোর সবচেয়ে ভালো অস্ত্র সম্ভবত মিডিয়াই। আবার সংবাদমাধ্যম যে একতরফাভাবে কেবল মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করে তা তো নয়। একটা সমাজে ক্রিয়াশীল আধিপত্যবাদী ধারণার প্রতিফলনও দেখা যায় গণমাধ্যমে। যখন থেকে খবরের কাগজ পড়তে পারি, তখন থেকেই দেখে আসছি এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষায় মেয়েদের ভালো রেজাল্ট নিয়ে নিউজ হয়। প্রতিবছর একই ঘটনা ঘটলেও আমার স্মরণকালে এই নিউজের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। যা নতুন নয় তা নিউজ কেন! এ জন্য যে, ধরেই নেওয়া হচ্ছে, মেয়েদের ভালো রেজাল্ট করার কথা ছিল না। মেয়ে হয়েও এত মেধা দেখাচ্ছে, কাজেই এটা নিউজ! অ্যাজ ইফ মেয়েরা মেধাবী নয়!

তেমনভাবেই চাওয়ালা বা রিকশাওয়ালা বা হরিজনদের মতো দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের সন্তানের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার কথা ছিল না এমনটা ধরে নিয়েই এই নিউজগুলো হচ্ছে। দরিদ্র মানুষও মেয়ে মানুষের মতো, আলাদা, অন্য, ওরা, আদার। এখন থেকে হয়তো বছর বছরই এসব নিউজ হতে থাকবে আর মধ্যবিত্ত বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের শেমিং করতে থাকবেন, সেই সঙ্গে না বুঝে অসম্মান করবেন ওইসব শ্রমজীবী বাবা-মাদেরও। অদৃশ্য থেকে যাবে সমাজের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র আর মধ্যবিত্তের উন্নাসিক মানসিকতার সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স।

লেখক : কবি ও লেখক

ummerayhana@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION