বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:০২ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
শুরু হয়েছে ১৪৪৫ হিজরির রবিউল আউয়াল মাস। এ মাসে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং এ মাসেই মদিনা মোনাওয়ারায় ইন্তেকাল করেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) এমন এক প্রিয় নাম, যা প্রত্যেক মুসলিম তার অন্তরে গভীর ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুল আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ -সুরা আলে ইমরান : ৩১
নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে ভালোবাসা ও তার প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী জীবনযাপন করা ইমানের অংশ। মুমিন-মুসলমানের অন্তরে যে কারণে আল্লাহর ভালোবাসা গভীর, সে কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা গভীর হওয়া স্বাভাবিক। এ ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ইমানদার তাদের ভালোবাসা গভীর হওয়া স্বাভাবিক।’ -সুরা বাকারা : ১৬৫
কোরআন মাজিদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।’ -সুরা আলে ইমরান : ৩১
বর্ণিত দুই আয়াত থেকে বোঝা যায়, মুমিন আল্লাহকেই বেশি ভালোবাসেন এবং এ ভালোবাসা প্রকাশের একমাত্র পথ হলোÑ রাসুলের অনুসরণ, অনুকরণ ও আনুগত্য। প্রশ্ন হলো, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা ছাড়া কি তার আনুগত্য সম্ভব? উত্তর, না।
ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, আল্লাহকে ভালোবাসার স্বাভাবিক পরিণতিই হলো রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসা। আর রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা কী পরিমাণ থাকা উচিত, সে কথা রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। সাহাবি হজরত আনাস (রা.) ও হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ওই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পরিপূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তোমাদের কাছে নিজ পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষ থেকে প্রিয় না হব।’ -সহিহ বোখারি : ১৫
বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালা পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজনকে ভালোবাসা কর্তব্য বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কারও প্রতি ভালোবাসা যেন রাসুলের চেয়ে বেশি না হয়, বরং সবার চেয়ে যেন রাসুলের প্রতি ভালোবাসা অধিকতর গভীর ও তীব্র হয়, সে কথাই এ হাদিসে বলা হয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে, আমাদের ভালোবাসা রাসুলের জন্য সবচেয়ে বেশি কি না তা যাচাই করার উপায় কী? এর হিসাব নেওয়া কঠিন নয়। অন্য কোনো মানুষের প্রতি ভালোবাসার দাবি পূরণ করতে গিয়ে যদি রাসুল (সা.)-এর নাফরমানি করা হয় তাহলে বোঝা যাবে, রাসুলের প্রতি ভালোবাসা অন্যের তুলনায় কম। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি অপরের পার্থিব স্বার্থে আখেরাত বরবাদ করেছে, কেয়ামতের দিন সে হবে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট ব্যক্তি।’ -ইবনে মাজাহ : ৩৯৬৬
মানুষ যদি দুনিয়ার ওপর আখেরাতকে প্রাধান্য দিত, তবে পৃথিবীতে সুদখোর, ঘুষখোর, ধর্ষক, সন্ত্রাসী কিছুই থাকত না। তাই আমাদের উচিত, জীবনের সবক্ষেত্রে আখেরাতকে প্রাধান্য দেওয়া; আল্লাহকে ভয় করা। যারা আখেরাতবিমুখ ও অন্যদের আখেরাত থেকে বিমুখ করার পাঁয়তারা করে, তাদের থেকে দূরে থাকা।
কারণ, মুমিন মাত্রই বিশ্বাস করেন, জীবনের সবক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হলেন- নবী কারিম (সা.)। সুরা আহজাবের ২১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য রাসুল (সা.)-এর জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনকে আদর্শরূপে গ্রহণ করলে সুফল তারাই পাবেন, যারা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করেন এবং আখেরাতের প্রতি ইমান রাখেন।
আমরা জানি, মানবজাতির জন্য মুক্তি ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহতায়ালা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। একটি নির্দিষ্ট সময় দুনিয়ার জীবনে দায়িত্ব পালনের পর মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবিবকে তার কাছে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আল্লাহর নাজিল করা পবিত্র কোরআন ও তার হাবিবের আদর্শ আমাদের মধ্যে আজও আছে। কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
যেহেতু হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ নবী। তারপর আর কোনো নবী আসবেন না। সুতরাং পরবর্তী উম্মতরা কীভাবে সত্যের দিশা পাবে এবং তার ওপর টিকে থাকতে পারবে সে প্রশ্নটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবী কারিম (সা.) বিদায় হজের ভাষণে উম্মতকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। কোরআন ও সুন্নাহ (হাদিস)। যতক্ষণ তোমরা এই দুটি বিষয় ধরে রাখবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না।’ -মুয়াত্তায়ে মালিক : ১৬২৮
ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘… রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের শুভ্র অবস্থায় রেখে যাচ্ছি। যার রাতও দিনের মতো আলোকময়। আমার পরে কেবল ধ্বংসপ্রাপ্তরাই তাতে বক্রতা খুঁজে পাবে। আমার পর তোমাদের যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের জন্য আবশ্যক হলো আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতের পথের পথিক খলিফাদের সুন্নাহ সর্বশক্তি দিয়ে ধারণ করা। আর সব নব উদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কারণ, সব নব উদ্ভাবিত বিষয় বিদআত। আর সব বিদআত গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা।’ -মুসনাদে আহমাদ : ১৭১৪২
দুঃখজনক হলেও সত্য, হাদিসের এমন স্পষ্ট ঘোষণার পরও তার উম্মত বলে পরিচয়দানকারী মুসলিম উম্মাহর একটি বিশাল অংশ দিগ্ভ্রান্ত। তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ ছেড়ে মনগড়া বিভিন্ন মতবাদ ও দর্শনের মধ্যে মুক্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে। আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান ছেড়ে মিথ্যা মরীচিকার পেছনে ছুটে দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংস করছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বেশি বেশি রাসুল (সা.)-এর সিরাত (জীবনালেখ্য) অধ্যয়ন করতে হবে। তার প্রদর্শিত নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করতে হবে। এ পথেই মুক্তি, এ পথেই সাফল্য।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
muftianaet@gmail.com