সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৪:৩৯ অপরাহ্ন
মনযূরুল হক:
গত পরশু (৭ অক্টোবর) থেকে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের একটু মাস দুয়েক পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। গত আগস্টে ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশ সেশেলস থেকে ১২৮ জন ইসরায়েলিকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল একটি বিমান। মধ্য আকাশে বিমানটিতে বৈদ্যুতিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় সৌদি আরবে জরুরি অবতরণ করে। এয়ার সেশেলসের বিকল্প বিমান পরদিন যথারীতি যাত্রীদের তেলআবিবে নামিয়ে দেওয়ার পর যাত্রীরা অবাক হয়ে লক্ষ করে বিমানবন্দরে তাদের অভিব্যক্তি শুনতে সাংবাদিক-ফটোগ্রাফারের ভিড় লেগে গেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ‘ইসরায়েলি যাত্রীদের প্রতি সৌদি কর্র্তৃপক্ষের উষ্ণ মনোভাবের ভূয়সী প্রশংসা’ করেন। পেছনে সেঁটে রাখা আরব মানচিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমি ভালো প্রতিবেশীর প্রশংসা করি।’
আপাত দৃষ্টিতে ঘটনাটি আকস্মিক দুর্ঘটনায় আরবের আতিথেয়তার একটি দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়। ঠিক তার এক বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল থেকে সরাসরি সৌদি আরব উড়ে গেলে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের জন্য সৌদির আকাশ খুলে দেওয়া হয়। তারও দুই বছর আগে ২০২০ সালে আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল-আরব সম্বন্ধ পাতানোর ঢেউ শুরু হয়। প্রথমে আরব আমিরাত ও বাহরাইন এবং পরে মরক্কো ও সুদান ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। ঢেউয়ে ক্রমাগত দুলতে থাকে অঞ্চলের অঘোষিত নেতা সৌদি আরব। বিমানের জরুরি অবতরণ ছিল তার একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া। আনুষ্ঠানিকতা ঘটে তার এক মাস পরে, সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখে। ঠিক সেই দিন, ১৯৬৯ সালের যেই দিন ফিলিস্তিনের আকসায় ইসরায়েলের অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের নেতৃত্বে। ৫৩ বছর পরে সেই দিনে ইসরায়েলের পর্যটনমন্ত্রী ইসরায়েলি বিমান নিয়ে জেদ্দায় অবতরণ করেন, জাতিসংঘের বিশ্বপর্যটন সম্মেলনে যোগ দেওয়ার অসিলায়। সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমান ফক্স নিউজের সাক্ষাৎকারে জানান, সৌদির সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক ‘দিন দিন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে’।
মুসলিমবিশ্ব একটি নতুন মেরুকরণ লক্ষ করে। যেই ওআইসির প্রতিষ্ঠার প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল আকসার মর্যাদা এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠা দিবসে তা করুণভাবে অবমানিত হয়। ঘটনাটি আলোড়ন তোলে ফিলিস্তিনিদের হৃদয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদ সংস্থাগুলো একের পর এক ফিলিস্তিনের ক্ষোভ উগরে দিতে থাকে। গত পরশুর আঘাত তাদের ক্ষোভের বারুদ বিস্ফোরিত হয়েছে মাত্র।
কাকতালীয় ব্যাপার হলো, যেই আকাশপথ ব্যবহার করে ধীরে ধীরে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বাতাস আরবজুড়ে বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছিল, ফিলিস্তিনিরা আকাশপথ ব্যবহার করেই তাদের অভিযান চালাল। মিডলইস্টআই একে ইসরায়েলের আকাশে অনাহূত ‘বজ্রপাত’ বলে অভিহিত করেছে। সমুদ্র ও স্থলপথেও আঘাত হানে তারা। বিশ মিনিটে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর দিকে ছোড়া ৫ হাজার ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে তাল রেখে শত শত ফিলিস্তিনি যোদ্ধা দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি সামরিক ও বেসামরিক এলাকায় হামলা চালায়। এ-পর্যন্ত চার শতাধিক ইসরায়েলি নিহত, দেড় সহস্রাধিক আহত এবং কয়েক ডজন সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিককে আটক করা হয়। বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি সামরিক অফিসার গ্রেপ্তার হয়েছেন, যারা দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের অজেয় মনে করতেন এবং প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবতেন।
গাজা যেহেতু ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামী জনগোষ্ঠীর আবাস, ফলে এখান থেকেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হবে স্বাভাবিকই। ‘অপারেশন আকসা ফ্লাড’ শুরু হওয়ার পরই হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া কারণটি পরিষ্কার ব্যাখ্যা করেন। আরব দেশগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমাদের যে-সব আরব ভাইয়েরা ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে, তারা দেখুক, যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে না, তারা আরবদের কী সুরক্ষা দেবে? ফিলিস্তিনে সমস্যা জিইয়ে রেখে আরবে কোনো সমাধান আসবে না।’ হামাস অভিযানের আরও দুটি উদ্দেশ্য তুলে ধরেছে। প্রথমত : ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, নিপীড়ন, অবৈধ বসতি স্থাপন এবং ফিলিস্তিনি ধর্মীয় প্রতীক, বিশেষ করে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ অপবিত্রকরণের জবাব দেওয়া। দ্বিতীয়ত : ইসরায়েলি কারাগার থেকে যতটা সম্ভব ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আরেকটি বন্দি বিনিময় নিশ্চিত করা।
আপাত অর্থে এই অভিযানকে মর্মান্তিক মনে হলেও অস্বাভাবিক ছিল না। কীভাবে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল, যেখানে ফিলিস্তিনিরা বরাবর প্রতিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সেখানে কী করে তারা আগ্রাসী হয়ে উঠল? ইসরায়েলের বিশ্বজুড়ে খ্যাতি কুড়ানো গোয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়িয়ে, তাদের সক্ষমতায় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়ে এমন পরিকল্পিত একটি অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হলো? নিশ্চয় এসব প্রশ্নের গবেষণা হবে। মাত্র কয়েকদিন হলো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘে গর্বদীপ্ত বক্তৃতায় ইসরায়েল এবং তার নতুন আরব অংশীদারদের কেন্দ্র করে একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। ফিলিস্তিন অঞ্চলকে কল্পনাপ্রসূত বলে মানচিত্র থেকে তাদের সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই আঘাত ইসরায়েলে রাজনৈতিক এবং কৌশলগতভাবে একটি মারাত্মক প্রভাব ফেলবে নিশ্চিত।
প্রায় এক বছর ধরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে তীব্র রাজনৈতিক বিভেদ চলছে। ইসরায়েলেরও গুপ্তচর, ড্রোন এবং নজরদারি প্রযুক্তির অত্যাধুনিক নেটওয়ার্কের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি রয়েছে। ফলে ইসরায়েলের এবার যে ক্ষতি হয়েছে, তা গোয়েন্দা বা সামরিক মাত্রা ছাড়িয়ে মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় বলেও চিহ্নিত করা যায়। একটি অপরাজেয় রাষ্ট্র ভেতরে ভেতরে কতটা অরক্ষিত, দুর্বল ও ফোকলা তা নিরাপত্তাকামী আরবদের আঙুল তুলে দেখিয়েছে। ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিপুল দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ বাড়িঘর এবং শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে এই ছবিগুলো এতদিন ছিল ফিলিস্তিনিদের, এবার ইসরায়েলের স্মৃতিতেও সেগুলো আগত বহু বছর ধরে গেঁথে থাকবে।
নিঃসন্দেহে ইসরায়েল তার ইমেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে, অতীতে যেমন করেছে এবং ইতিমধ্যে ভয়াবহ বোমাবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড শুরুও করেছে তারা। ফিলিস্তিনিদের যতটা সম্ভব দুর্ভোগে ফেলবে এবং অগণিত হতাহতের ঘটনা ঘটবে। অতীতে বারবার তা-ই ঘটেছে, কিন্তু তা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে ধ্বংস করবে না। সাম্প্রতিক ঘটনায় ইসরায়েল যদি আবারও সেই কট্টরপন্থা এবং ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূলের দিকে যায় একটা বড় ভুল হবে।
প্রথমত : এমন হলে তা একটি পূর্ণাঙ্গ অপ্রতিসম যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে গোটা অঞ্চলকে। যেমন ইতিমধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহও অভিযানে যোগ দিয়েছে; যা ইসরায়েলকে সীমান্তে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। দ্বিতীয়ত : ফিলিস্তিনিরা আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে। পশ্চিম তীরের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ঐক্যের সুরে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।’ তৃতীয়ত : যেই উদ্দেশ্য নিয়ে নেতানিয়াহু সরকার আরববিশ্বে পা বাড়িয়েছিলেন, তা ভন্ডুল হয়ে যাবে। চতুর্থত : অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া নেতানিয়াহু সরকারের রাজনৈতিক জোটের উদারপন্থি অংশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। পঞ্চমত : পশ্চিমা নেতারা, যারা এই পর্যন্ত নেতানিয়াহুকে সমর্থন করেছেন এবং ইসরায়েলি সব সহিংসতায় স্বচ্ছভাবে কপট সংহতি প্রকাশ করেছে, তারা বর্তমান সরকার থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করতে পারে।
যেহেতু যুদ্ধটি মূলত গাজা থেকে শুরু হয়েছে এবং নেতৃত্ব দিচ্ছে হামাস, তাই অনেকে একে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ বলে ছোট করতে পারেন। তাদের মনে রাখা উচিত, ফিলিস্তিনের বর্তমান জনসংখ্যার ৪০% ভাগের বসবাস গাজায়। অনেকে অভিযোগ করেন, ‘ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের লক্ষ্য পূরণ করছে হামাস। ইসরায়েল চায় না ফিলিস্তিনিরা ঐক্যবদ্ধ থাকুক। হামাসের উদ্ভবের কারণেই ফিলিস্তিনের মানুষ এক পতাকার ছায়ায় থাকতে পারেনি।’ কিন্তু ফিলিস্তিনি-আমেরিকান লেখক এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন পর্যবেক্ষক মারয়াম বারগুসি এ-জাতীয় সংশয়কে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি টুইটারে গতকাল লিখেছেন, ‘এটা হামাসের লড়াই নয়, বরং এই যুদ্ধ হামাসকে সামরিক কারণে সম্পৃক্ত করেছে। এই যুদ্ধ সব ফিলিস্তিনের বাঁচার লড়াই, নিঃশ্বাসের লড়াই। হামাসের লড়াই বলা প্রকারান্তরে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামকে হাইজ্যাক করার অশুভ চেষ্টা, একটি কৌশলগত ফাঁদ। গত ২০ বছরে এই প্রথম গাজাবাসী ইসরায়েলিদের মৃত্যু দেখেছে। দুই দশক ধরে যে-মৃত্যু আকাশ ভেদ করে ফিলিস্তিনিদের ওপর আসত, আজ প্রথমবার সেই মৃত্যু আকাশপথে গতিপথ ও সীমানা বদলেছে। কয়েক বছর আগে গাজা অবরোধের প্রতিবাদে হিলিয়াম ভরা বেলুন উড়ানোয় যাদের সন্ত্রাসী বলা হতো, আজ তারা প্যারাট্রুপার হয়ে ৭৫ বছরের আগের সেই ভূমিতে উড়ে গেছে, যে-ভূমি থেকে তাদের বের করে দেওয়া হয়েছিল।’
রাষ্ট্র-সরকারের হিসাবের বাইরে এবারের যুদ্ধ নিশ্চয় দুই দেয়ালের দুইপাশের জনগণের মধ্যে সমানভাবে অবশ্যম্ভাবী একটি প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দেবে একই ভূখণ্ডের দুইপ্রান্তের জনগণ, যারা বিশ্বের দাবার ঘুঁটির চালে একদিকে নিগৃহীত এবং অন্যদিকে স্বর্গসুখে ছিল, তারা শান্তিতে বাঁচতে চায় নাকি লড়াই করে মরতে চায়? ফিলিস্তিনিরা তো স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা অপমানে হাঁটু গেড়ে মরার চেয়ে ন্যায় ও স্বাধীনতার জন্য তাদের পায়ে ভর দিয়ে লড়াই করবে। এবার ইসরায়েলি জনগণ বুঝুক, ফিলিস্তিন জাহান্নাম হলে ইসরায়েলও প্যারাডাইস হয়ে থাকবে না।
লেখক : অনুবাদক ও লেখক
manzurul.haque267@gmail.com