সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৩:২২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

গাজা কি স্বাধীন রাষ্ট্র হতে পারে

মনযূরুল হক:
২০০৫ সালে গাজা উপত্যকা থেকে সেটেলার ইহুদিদের প্রত্যাহারের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন বলেছিলেন, ‘এর মাধ্যমে ইসরায়েলি নাগরিকদের সর্বাধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।’ আশাবাদীরা বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত গাজাকে একদিন মধ্যপ্রাচ্যের হংকংয়ে পরিণত করবে। গাজা থেকে ইসরায়েল তখন প্রায় ৮৫০০ ইহুদি বসতি সরিয়ে নেয়। শ্যারনের এই উদ্যোগ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের একটি মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়। কেননা, প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনিরা এমন এক টুকরো ভূখণ্ড পেয়েছে, যার ওপর তাদের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। যদিও প্রত্যাহারের আগে থেকে গাজা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরত্বের ‘ইসদুদ’ পর্যন্ত প্রায় ৩,৫০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি ইসরায়েল দখল করে রেখেছে; যা গাজার মোট আয়তনের ১০ গুণ বড়। প্রত্যাহারের চার মাস পর, হামাস ফিলিস্তিনি আইনসভা নির্বাচনে জয়ী হয়। হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। বছর না-ঘুরতেই পিএলও বেঁকে বসে। ২০০৭ সালের গ্রীষ্মে পিএলওর সশস্ত্র শাখার বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে এবং গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দখল করে হামাস। এরপর গত ১৫ বছরে গাজার দুই মিলিয়ন বাসিন্দা ইসরায়েলের সাতটি যুদ্ধ সহ্য করেছে; যা ১২,০০০-এরও বেশি গাজাবাসীকে হত্যা করেছে এবং কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ছিলেন শ্যারনের অর্থমন্ত্রী, বসতিস্থাপনকারী ইহুদি প্রত্যাহারের সূত্র ধরে তিনি পদত্যাগ করেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ তখন প্রত্যাহারকে সমর্থন করলেও ২০১৫ সালে এসে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘জনসংখ্যার দিক থেকে সিদ্ধান্ত সঠিক মনে হলেও নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে গাজাকে বিচ্ছিন্ন করা ছিল ভুল। আমরা আমাদের মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছি যে, প্রত্যাহারের পর গাজা মধ্যপ্রাচ্যের হংকং হয়ে যাবে, বরং দেখা যাচ্ছে তা একটি বড় রকেট বেস হয়ে উঠেছে।’

‘ভুল’ শোধরাতে ইসরায়েল একটি নতুন স্ট্র্যাটেজি সামনে আনে গাজাকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র থেকে আলাদা করে ফেলা। নির্বাচনে হামাসের জয়লাভের পর থেকে উদ্যোগের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি রাজনীতিক মোহাম্মাদ দাহলানের মুখোশ উন্মোচিত হয়; যিনি ছিলেন হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গাজায় পিএলও বাহিনীর প্রধান (ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুতে তাকে প্রধান অভিযুক্ত বলে মনে করা হয়)। হামাসকে ঠেকাতে তিনি নিয়মিত সিআইএর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এমনকি গাজায় পিএলও বাহিনীর অস্ত্র সরবরাহেও ইসরায়েল অবাধ অনুমতি প্রদান করে। মোহাম্মাদ দাহলানের ঘটনা ফিলিস্তিনি রাজনীতির একটি বৃহত্তর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। যদিও হামাস ও পিএলও নেতারা বছর দুয়েক পর পর মিলিত হন, তবে কোনো পক্ষ স্থায়ী সমঝোতায় আগ্রহী বলে মনে হয় না। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই গাজা ও পশ্চিম তীরের বিভক্তিকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে বাধাগ্রস্ত করার একটি কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত করেন। ফলে ইসরায়েল ক্ষণে ক্ষণে গাজা একটি পৃথক ‘রাষ্ট্র’ ধারণাটি উসকে দিতে থাকে। কিংবা ডি-ফ্যাক্টো রাষ্ট্র। মানে আইনে যা-ই থাকুক, গাজার শাসনব্যবস্থা প্রমাণ করে, এটা একটি স্বতন্ত্র দেশ। ২০১৮-এর যুদ্ধের পর ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান মেজর জেনারেল জিওরা আইল্যান্ড ওয়াইনেট-নিউজে লেখেন যে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা এবং হামাসের দখলের পরে গাজা উপত্যকা কার্যত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তিনি লেখেন, ‘এর স্পষ্ট সীমানা রয়েছে, একটি কার্যকর সরকার, একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং একটি সেনাবাহিনী আছে। এগুলো একটি রাষ্ট্রের সঠিক বৈশিষ্ট্য।… কেবল নিরাপত্তার কারণ ছাড়া গাজার প্রতি ইসরায়েলের কোনো অর্থনৈতিক আগ্রহ নেই।’

ইসরায়েলের ওপেন ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সোশিওলজির অধ্যাপক ইয়াগিল লেভি হারেৎজে লিখেছেন ‘গাজা প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র, অন্তত সমাজ বিজ্ঞানীরা এই শব্দটি বোঝেন।… তবে গাজা হলো নির্বাসিত রাষ্ট্র। ইসরায়েল ও মিসর এর সীমানা নিয়ন্ত্রণ করে। ফিলিস্তিনি কর্র্তৃপক্ষ হাতেগোনা সিভিল সার্ভেন্টকে বেতন দেয়। ফিলিস্তিনি সেনাবাহিনীর কর্র্তৃত্ব নেই সেখানে।’ সাবেক ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিখেছেন ‘গাজা আদতে একটি রাষ্ট্র, যেহেতু তার সরকার, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং আদালত রয়েছে, যা ন্যায়বিচার প্রদান করে।’ ইসরায়েলি বিচারমন্ত্রী আয়েলেত শ্যাকড-ও জর্ডান সম্মলনে গিয়ে গাজাকে ‘একটি স্বাধীন রাষ্ট্র’ বলেছেন। আবার প্রো-প্যালেস্টাইনি মতও আছে। পলিটিক্যাল অ্যাকাডেমিশিয়ান জফ্রি অ্যারনসন গাজাকে প্রোটো-রাষ্ট্র আখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন ‘গাজা উপত্যকায় যে সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য আছে, রামাল্লা-ভিত্তিক মাহমুদ আব্বাস তা কেবল স্বপ্ন দেখতে পারেন। গাজা একটি একক, বাস্তব সীমানাসহ সংলগ্ন অঞ্চল ও ভূখণ্ডের স্বীকৃতি রাখে বন্ধু ও শত্রু উভয়ের মাধ্যমে; যদিও সবসময় তার মর্যাদা রক্ষা করা হয় না।’

ফিলিস্তিন সংকটে বরাবর দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের পক্ষে জাতিসংঘ। কিন্তু গত ৭ অক্টোবর ঘটনার পরে সেটাকে ত্রি-রাষ্ট্রিক পরিণতিতে নেওয়ার প্রবণতা আশঙ্কজনক হারে বাড়ছে বলে মনে করা হয়। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইমেরিটাস চেয়ার অ্যান্থনি করডেসমন মতে ৭ অক্টোবরের ঘটনা দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের মৃত্যু ঘটিয়েছে।

২০১২ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মাদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আল-আরাবিয়া সংবাদে জানায়, তাদের আলোচনার প্রধান এজেন্ডা ছিল গাজাকে মিসরের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা, অথবা তাকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, হামাস ও পিএলও একমত না হওয়ার কারণ কেবল আদর্শিক নয়, গাজা ও পশ্চিম তীরের ভৌগোলিক দূরত্ব এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যও অন্যতম কারণ। একাত্তর-পূর্ব বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করেন তারা; যেখানে একটি দেশকে অন্য একটি দেশের ভূখণ্ড দু-টুকরো করে দিয়েছে। তবে পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল বাংলাদেশ থেকে ২২০০ কিলোমিটার, আর পশ্চিম তীর থেকে গাজার দূরত্ব মাত্র ৯৩ কিলোমিটার। অবশ্য ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের মানচিত্রে এই দূরত্ব ছিল না; বরং সাগর-তীরবর্তী ‘ইসদুদ’ ও পশ্চিম তীরের ‘কাসতিনা’কে মিলিয়ে দেখানো হয়েছে। পরে ইসরায়েল দুটি গ্রামকে গ্রাস করে নেয়। ১৯৬৭ সালে গাজাকে পশ্চিম তীরের সঙ্গে যুক্ত করা হয় করিডর দিয়ে। জেনেভা অ্যাকর্ডে দেখা যায়, গাজা থেকে ইসরায়েলে ইরেজ ক্রসিং পার হয়ে বেথলেহেম পর্যন্ত যাওয়ার করিডর রাখা হয়েছে; যেখান থেকে জ্বালানি, পানি, বিদ্যুৎ, সংযোগ সড়ক, এমনকি রেললাইন করা যাবে।

আয়তনের বিবেচনায়ও গাজা ক্ষুদ্র, ঢাকার সমান মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৩০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাষ্ট্র আছে ৩০টি। গাজা আয়তনে মাল্টা ও মালদ্বীপের চেয়ে বড় এবং বাহরাইন ও সিঙ্গাপুরের অর্ধেক। প্রশ্ন হলো, কেবল ভূখণ্ড নিয়ে গাজা স্বাধীন হতে পারবে কি না? ইসরায়েল এখনো গাজার সীমানা নিয়ন্ত্রণ করে এমনকি মিসরের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করে তারা। উপকূলে তাদের নৌ-অবরোধ রয়েছে। গাজার আকাশসীমা তাদের নিয়ন্ত্রণে। গাজার ভেতরের বেশিরভাগ অর্থের প্রবাহের নিয়ন্ত্রক তারা। শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে এই অবস্থার পরিবর্তন কি সম্ভব? আবার এভাবেও বলা হয় যে, এত অবরোধের পরেও যেহেতু তারা টিকে আছে, তাহলে স্বাধীন হলে আরও ভালোভাবে পারবে কি না।

লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর ফিলিস্তিনি গবেষক গাদা কারমি অবশ্য দ্বি-রাষ্ট্র বা ত্রি-রাষ্ট্র সব ধারণাকেই নাকচ করে দিয়ে বলেছেন ‘ওয়ান স্টেট’ সমাধানের কথা। তার আলোচিত ‘ওয়ান স্টেট : দ্য অনলি ডেমোক্রেটিক ফিউচার অব প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল’ নামক গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের অধিবাসীদের ধর্ম বা ভাষা ভিন্ন হওয়াটা একত্রে থাকার প্রতিবন্ধক নয়, বরং যদি গণতন্ত্র থাকে, যদি জনসাধারণের সবার ইক্যুয়াল পাওয়ার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়, তাহলে ‘ওয়ান স্টেট’ বেস্ট সমাধান। আর যদি এর উল্টো হয়, তাহলে দ্বি-রাষ্ট্র দিয়েও সমাধান হবে না, শান্তি আসবে না।

কিন্তু গাজাবাসী কী চায়? নিশ্চয় তাদের কাছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাই মুখ্য। ভৌগোলিক কারণে গাজা ও পশ্চিম তীরকে দূরে মনে হলেও গাজার অভ্যন্তরীণ নীতিমালাতেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। সম্প্রতি গাজায় হামাসের বন্দি ইসরায়েলিদের মুক্তির বিনিময়ে যে-সব ফিলিস্তিনি মুক্তি পাচ্ছে, তার অধিকাংশ পশ্চিম তীরের বাসিন্দা, গাজার নয়। আলজাজিরার সাক্ষাৎকারে ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের ফেলো এবং জিউস ভয়েস ফর পিস’র আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা ফিলিস বেনিস স্বাধীনতার প্রশ্নটি তুলে ধরে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের জন্য তো কোনো ভূমি বাকি রাখা হয়নি, আরেকটা রাষ্ট্র হবে কোথায়? ফিলিস্তিনিরা কী সমাধান চায়, সেটা বলার আমি কে? সেটা বলতে পারে তারা, যারা সেখানে বাস করে। আমি যেখানে ট্যাক্স পরিশোধ করি, তারা সমাধানে অগ্রসর হলে বলতে পারি, ওই ভূমিতে যা-ই হোক, সমান হতে হবে। যদি একক রাষ্ট্র হয়, তাহলেও সবার জন্য সমান সুবিধা থাকতে হবে; যদি দুটি রাষ্ট্র হয়, তাহলে উভয় রাষ্ট্রের ভেতরে ও সর্বক্ষেত্রে সবার জন্য সমান অধিকার থাকতে হবে।’

সূত্র: রয়টার্স, ওয়ানেট নিউজ, হারেৎজ, টাইমস অব ইসরায়েল, আলজাজিরা,

সিএসআইসি, আল-আরাবিয়া (ইংলিশ), জেনেভা অ্যাকর্ড।

লেখক: লেখক ও অনুবাদক

manzurul.haque267@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION