সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৩:১৮ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নির্বাচন কোনোভাবেই অবৈধ নয়

ফজলুল বারী:
আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বৈধতা পাবে কি না তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক এখন দেশে-বিদেশে। আমার উত্তর, বৈধতা পাবে। বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও আগের দুটি নির্বাচনের তুলনায় অনেক বেশি ভোটার অংশ নেবেন সামনের নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের ডামি অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলবে। সংবিধান ও নির্বাচন বিধিমালায় নির্বাচনের সাফল্যের জন্য ভোটারদের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠনের নাম বিধিমালায় উল্লেখ থাকে না।

শিখরা বিশ্বাস করেন মানবজাতি ‘শিখ’ ও ‘অশিখ’ দু’ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি শিশু শিখ হিসেবে জন্ম নেয়। চুল কাটার পর তারা অশিখ হয়ে যায়। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও অ্যান্টি আওয়ামী লীগ এমন দু’ভাগে বিভক্ত। বিএনপি এখানে অ্যান্টি আওয়ামী লীগ রাজনীতির মূলধারা।

বিএনপি শুধু নির্বাচন বর্জন নয় প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। মোটাদাগে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটি দল নির্বাচনে অংশ নিলে সেই নির্বাচনকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। বিএনপি না থাকায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা আর শান্তি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। কিন্তু এর জন্য নির্বাচনকে অবৈধ বলা যাবে না। নির্বাচন কমিশন ও সরকার একটি ভালো নির্বাচন প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মাথার ওপর মার্কিন খড়গের হুমকিও আছে। বাংলাদেশের জন্মশত্রু দেশটিকে এড়িয়ে চলার সুযোগ-পরিকল্পনাও বাংলাদেশের নেই। জাতিসংঘর সদর দপ্তরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিদেশি নজরদারির কারণে নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট সিরিয়াস মনে হচ্ছে। নির্বাচন তদারকির বৈধ কর্র্তৃপক্ষ হিসেবে ঢাকায় কর্মরত বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধি, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কর্মকর্তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে নির্বাচন কমিশনেই যাচ্ছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশি পর্যবেক্ষক যারা আসবেন, তারা নির্বাচন কমিশনের কাছেই আবেদন করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে এখন একটি নির্বাচনকালীন সাংবিধানিক সরকার কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন আইনত এখন নির্বাচন কমিশনের অধীন। দেশের সব ইউএনও, ওসিকে বদলির আদেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কয়েকজন জেলা প্রশাসককেও বদলি করা হয়েছে। বিরোধীরা এটিকে নির্বাচন কমিশনের আইওয়াশ বললেও বাংলাদেশের কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এর আগে কোনো নির্বাচন কমিশন এ ধরনের বড়মাপের প্রশাসনের বদলির সিদ্ধান্ত নেয়নি।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন অ্যান্টি আওয়ামী লীগ দলগুলো প্রথম দিন থেকেই এই নির্বাচন কমিশনকেও মানে না। তাদের কাছে এটি অবৈধ নির্বাচন কমিশন। আবার দাবি-দাওয়ার সবকিছু এই ‘অবৈধদের’ কাছেই! যেমন ‘অবৈধ’ সরকারের কাছে ছয় মাস পরপর খালেদা জিয়ার দ- স্থগিতের মেয়াদ বাড়িয়ে জেলখানার বদলে বাসায় থাকার সুযোগ চেয়ে আবেদন করা হয়! নির্বাচন কমিশনকে ‘অবৈধ’ দাবি করে এর কোনো বৈঠক-সংলাপে বিএনপি যায়নি। আবার নিবন্ধন ধরে রাখতে দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব ‘অবৈধ নির্বাচন কমিশন’-এর কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। তারা নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। না এর মাধ্যমে বিএনপিকে নির্বাচন বর্জনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্ন আছে! মোটা দাগের একটি দিক আছে বাংলাদেশের রাজনীতির। একটি দল নির্বাচন বর্জন করতেই পারে। এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু কেউ যদি নির্বাচন করতে চায়, তাদের প্রতিহত করার কৌশল-ঘোষণা কি গণতান্ত্রিক? নির্বাচন করতে চাওয়াও তো যে কারও গণতান্ত্রিক অধিকার। হরতাল-অবরোধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে বিরুদ্ধ মতের কোনো স্থান নেই! এক দল হরতাল বা অবরোধ ডাকলে তা সবাইকে মানতেই হবে। আগে রাজনৈতিক দলগুলো হরতালের আগের সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের করত। এখন পুড়িয়ে দেওয়া হয় গাড়ি! জ্বলন্ত গাড়িতে মৃত্যু হয় ঘুমন্ত সহকারীর!

বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত এমন একটি নির্বাচন হয়নি যে নির্বাচন সবার প্রতিক্রিয়ায় গ্রহণযোগ্য-বৈধ হয়েছে! দেশের ইতিহাসের প্রথম জালিয়াতির নির্বাচন হয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে! ‘হ্যাঁ’, ‘না’ ভোটে কেন্দ্রে কোনো ভোটার ছিল না। সামরিক নির্দেশে কেন্দ্রে কেন্দ্রে শিক্ষকরা নিজেরাই ব্যালট-বাক্স ভর্তি করেন! জিয়ার সেই ভোট ডাকাতির নির্বাচনকে বিএনপি কোনো দিন অবৈধ বলেনি। ১৯৮৮ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচন সব বিরোধী দল বর্জন করে। আজকের বিএনপির অনুসারী গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা আ স ম আব্দুর রব সেই ভোটারবিহীন নির্বাচনে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন! গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হলে তার দলের মন্ত্রী-নেতাদের মতো

আ স ম রবও পালিয়ে যান। সরকারের পতন হলে বিরোধী দলের নেতাও পালায়, এমন ইতিহাস দ্বিতীয়টি নেই। ১৯৯১ সালে দেশে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বিজিত দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী দল বিএনপিকে অভিনন্দন না জানিয়ে ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ করে। সেই নির্বাচনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরত নিতে যে রেফারেন্ডাম হয়েছিল, তাতেও ভোটাররা অংশ না নেওয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে আমরা জাতির বিবেক হিসেবে সম্মান করে গেছি। একটি জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে ফেরত যেতে তাকে তার বিবেক বাধা দেয়নি! একটি নির্বাচন হয়ে গেলে সেটি ‘বৈধ’ হয়ে যাওয়ার এমন ‘ম্যাজিক’ বাস করে আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থাপনার ভেতরেই! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বেনিফিশিয়ারি খালেদা জিয়া নির্বাচনে জয়ী হয়ে এই সরকারব্যবস্থাকেই অস্বীকার করে বসেন! সেই খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন একটি জালিয়াতির নির্বাচন করেন। মেজর রশীদসহ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সেই নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করে সংসদে নিয়ে আসা হয়।

গণআন্দোলনের চাপে টিকতে পারেননি খালেদা জিয়া। সারা রাত সংসদ অধিবেশন চালিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পাস করিয়ে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। সেই ‘অবৈধ সংসদে’ পাস করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসে। আবার পাঁচ বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আওয়ামী লীগ যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে, সেই বেলতলায় যেতে আর রাজি হয়নি দলটি। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল মন্দের ভালো। কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরাবরই এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থার বড় ভিকটিম। পনের বছর ক্ষমতায় থেকে নানান অবিস্মরণীয় উন্নয়ন কর্মকা- করেও আওয়ামী লীগ নির্ভার হতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিচার বিভাগের ক্ষতি করছে, ইমিডিয়েট পাস্ট প্রধান বিচারপতিকে পেয়ে যাচ্ছে লোভে, এই যুক্তিতে বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলে আওয়ামী লীগ এটিকে আইনানুগ করে ফেলতে দেরি করেনি। এটি দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এখন জেদাজেদির পর্যায়ে চলে গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। একদল মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানলেই আমাদের হার। আরেক দল মনে করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে নির্বাচনের আগেই আমাদের হার। এখানে কেউ ভোটের আগেই হারতে রাজি নয়। সবাই আগে চায় তালগাছের মালিকানাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা।

বিএনপির বর্জন আর অংশগ্রহণ সত্ত্বেও ২০১৪, ২০১৮’র নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত হয়নি। এরপরও ক্ষমতায় টিকে গেছে আওয়ামী লীগ। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার ফর্দসমূহ সামলে আওয়ামী লীগ ধারাবাহিক দুই টার্ম ক্ষমতায় থাকলেও দেশে রাজনৈতিক শান্তি তৈরি হয়নি। এবার কঠিন হলো অ্যান্টি আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বও তাদের বিরুদ্ধে। এ অবস্থার ভেতর বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচনে ভোটার সমাবেশ ঘটানোর আশায় দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে ডামি প্রার্থীর নামে স্বতন্ত্র প্রার্থী-বিদ্রোহী প্রার্থীর অভূতপূর্ব অনুমোদন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিংস পার্টি জাতীয় পার্টি-বিএনপি জোটের জেনারেল ইবরাহিম-বিএনপির শাহজাহান ওমররা ভোটে এলেও রাজনৈতিক স্বস্তি আসেনি। এরপরও ৭ জানুয়ারি ভোট হয়ে গেলে, তা কোনোভাবেই অবৈধ হবে না। কারণ সরকার-নির্বাচন কমিশন দুটোই আইনানুগ বৈধ প্রতিষ্ঠান। মনে রাখতে হবে, দিনশেষে আমেরিকাও বিজয়ীর সঙ্গে থাকে।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, সিডনি, নিউসাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া

fazlulbari2014@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION