সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০১:৪৭ পূর্বাহ্ন
জি.বি.এম রুবেল আহম্মেদ:
বাঙালি হিসেবে গুজব রটানো ও বিশ্বাস করা এটি যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। ঘটনার আগে-পিছে আমরা ভাবি না। সত্য-মিথ্যার যাচাই-বাছাই করি না। বর্তমানে ‘অপপ্রচার’ বা ‘গুজব’ শব্দটি নানা কারণে একটি আলোচিত বিষয়। একটা কথা বানিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারলেই ভাইরাল হওয়া যায়! তবে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এসব কাজ করেন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অথবা কোনো চক্রান্ত মহল। ছোট্টবেলায় শুনতাম ‘চিলে কান নিয়েছে বলে চিলের পিছে অবিরাম ছুটছে, অথচ নিজের কানে একবারও হাত দিয়ে দেখেনি, কান তার আছে কিনা?’ বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির ব্যবহারে মানুষ সেই গল্পের মতোই হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত একটার পর একটা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইউটিউব ও টিকটকসহ নানা মাধ্যমে গুজব রটাচ্ছে। যে কোনো সরকারি, বেসরকারি, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এসব প্রতিনিয়ত ঘটছে। কিন্তু এটি কতটুকু সত্য, তা না জেনেই ভাইরাল করে দিচ্ছে। ফলে যাকে নিয়ে বা যেসব বিষয়ে গুজব ছড়াচ্ছে তার বা তাদের সমাজে আত্মসম্মান হরণ হওয়ায় বাধ্য হয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। এসব নতুন নয়। এর আগেও দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল নিয়েও গুজব রটানো হয়েছিল।
ইদানীং নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিভিন্ন মহলে কানাকানি, হাসিঠাট্টা, অভিযোগসহ বিভিন্ন ধরনের বিরূপ মন্তব্য ইন্টারনেট মাধ্যম ও চা-স্টল আড্ডায় পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেউ হয়তো বুঝে বলছেন, কেউ আবার না বুঝেই তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমালোচনা করছেন। সম্প্রতি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, শিক্ষিত-মূর্খ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে ফেসবুকে আপলোড করছেন।
কিন্তু এটি মূলত কাদের প্রশিক্ষণ বা কোন দেশের তা নিয়ে কারও সত্যতার যাচাই-বাছাই নেই। ভাইরাল হওয়ার বেশ কিছুদিন পরে এর সত্যতা মিললেও এখনো সর্বমহলে সেটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। নতুন শিক্ষাক্রম সমালোচনার মুখে ফেলেছে এসব ভাইরাল ভিডিও। ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণের’ ভিডিওগুলো। দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারী অনেকে সেগুলো শেয়ার করে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন। ভিডিওগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা মহলে তর্ক-বিতর্ক।
ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে দেখা মিলেছে ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ‘টিরিং টিরিং সাইকেল চালাই’, ‘আবৃত্তির সঙ্গে ব্যাঙ লাফ’, ‘হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক ডাক দিতে দিতে হেঁটে চলা’।
আসলেই কি ভাইরাল ভিডিওগুলো নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষক প্রশিক্ষণের? অনুসন্ধানে দেখা মিলল, কিছু ভিডিও বাংলাদেশের নয়। কয়েকটি ভিডিও বেশ কয়েক বছর আগের প্রশিক্ষণের এবং সেগুলো নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ নয়। প্রশিক্ষণের ফাঁকে শিক্ষকদের একঘেয়েমি দূর করতে বিনোদনমূলক কার্যক্রম মাত্র। আবার কোনো ভিডিও শারীরিক শিক্ষা ক্লাসের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য, যা অনেক আগেও ছিল। ভাইরাল ভিডিওগুলোর মধ্যে শুধু হাঁসের ডাক দিতে দিতে দুই হাত মেলে হাঁটার ভিডিওটি প্রশিক্ষণের অংশ। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের গণিত শেখাতে এ প্রক্রিয়া রয়েছে। আর বহুল আলোচিত ‘টিরিং টিরিং সাইকেল চালাই’ এই প্রশিক্ষণটি ভারতের আসাম রাজ্যের। এটি একটি শিশু শ্রেণির কবিতা। ‘এ কবিতাটি আসামে ‘ভঙ্গিমা গীতি’ হিসেবে পরিচিত।
প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলে এটি অভিনয় করে পড়ানো হয়। বিভিন্ন যানবাহন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পরিচিত করে তুলতে এটা প্রাইমারি লেভেলে শেখানো হয়। এ ছাড়াও প্রশিক্ষণের যে ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে, সেটা অনেক পুরনো।’ এমনটাই জানা গেছে ওই ভিডিও প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক আসামের একটি স্কুলের শিক্ষক রতন লাল সাহার কাছ থেকে। তার ফেসবুক ওয়ালে দেখা মিলে, ওই ভিডিওটি তিনি ২০২০ সালে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আপলোড করেছিলেন। বাংলাদেশের কে বা কারা সরকারের বিরুদ্ধে বা নতুন শিক্ষা কারিকুলামকে বিতর্কে ফেলতে দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নামে বিরূপভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও তাল মিলিয়ে যাচ্ছি, যা সচেতন ও শিক্ষিত জাতি হিসেবে লজ্জাকর বিষয়।
নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক অভিভাবক, শিক্ষার্থী, কিছু শিক্ষকসহ সর্বমহলে আলোচনা-সমালোচনা হলেও এর ভালো দিক রয়েছে। নতুন একটি ব্যবস্থা চালু হলে সেই ব্যবস্থার আশানুরূপ ফল পেতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও বিদ্যমান কারিকুলামের পরিবর্তে নতুন কারিকুলামের দৃশ্যমান ফল পেতে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নেতৃত্বে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন কারিকুলামে মুখস্থনির্ভরতা লেখাপড়া আর থাকবে না। মুখস্থ করার পরিবর্তে নিজ দক্ষতা ও কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান আত্মস্থ করতে পারবে। এতে করে পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থাও বদলে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা মনের আনন্দে সহজভাবে পড়াশোনা করতে পারবে। এখানে আরও যুক্ত হয়েছে শিল্পসংস্কৃতিচর্চা। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ শেখার পাশাপাশি আরও রান্নাবান্না, ছবি আঁকা, গান-আবৃত্তি, অভিনয়, স্পোকেন ইংলিশ, হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে সহজেই লালন করতে পারবে। মূল্যায়ন পদ্ধতিটাও পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর অভিভাবকরা জিপিএ ৫ বা এ প্লাসের অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন না। কারণ, মূল্যায়নে শিক্ষার্থীরা একক ও দলীয়ভাবে কাজ করবে। তাদের মূল্যায়ন এখন তিনটি চিহ্নের মাধ্যমে করা হবে। বৃত্ত, বর্গ ও ত্রিভুজ। সর্বোচ্চ ভালো ফলাফল ত্রিভুজ। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাতে অভাবনীয় পরিবর্তন আসবে। যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নতুন কারিকুলাম চালু করা হয়েছে, সেটি আশানুরূপ ফল পেলে শিক্ষাপদ্ধতি যথার্থ সার্থক হবে বলে সবার ধারণা। আসুন, দেশকে ভালোবেসে সব উদ্ভাবনী কাজে সহায়তা করি। গুজবকে না বলি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
rubellahmmed1998@gmail.com
ভয়েস/আআ/সুত্র: দেশরূপান্তর