রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৮:৫২ অপরাহ্ন
শাহাদাৎ হোসাইন:
ইতিহাসবিদরা বলছেন, পশ্চিমে যখন নারীরা সমাজে অবমূল্যায়িত সে সময়েই মুঘল দরবারে ক্ষমতার কলকাঠি নেড়েছেন নারীরা। স্ত্রী প্রেমে অনুরক্ত সম্রাটদের বিবিরা হয়ে উঠেছেন ‘বাদশাহ ই বেগম’। পারস্য বংশোদ্ভূত শিয়া পণ্ডিত আলী আকবর জামির চৌদ্দ বছর বয়সী কিশোরী কন্যা হামিদা বানুর প্রেমে পড়েন দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুন। ধর্মাদর্শে সুন্নি মুঘল পরিবারের শিয়া কন্যাকে ঘরে তুলতে আপত্তি ছিল। কিন্তু হুমায়ুন ক্রমে দুর্বল হয়ে ওঠেন হামিদার প্রতি। পরবর্তী সময় হুমায়ুনদের বোনদের মন জয় করেছিলেন পারস্য কিশোরী হামিদা, হয়ে ওঠেন অন্দরমহলের প্রভাবশালী বেগম। সম্রাট হুমায়ুন যখন রাজ্য হারিয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরছেন তখন হামিদার গর্ভে জন্মলাভ করে মুঘল সাম্রাজ্যের পরবর্তী সম্রাট মহামতি আকবর। সে সময় হুমায়ুনপতœী হামিদার খুব বেদানা খেতে শখ হলে কল্পনায় তিনি বেদানা খাচ্ছিলেন। তা দেখে ভগ্নহৃদয়ে হুমায়ুন হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। এক সময় ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসেছিলেন। তখন তার সামনে জঙ্গলে এক পথ হারানো পথিক একটি বেদানা দিয়ে যান। হুমায়ুন আর কালবিলম্ব না করে হামিদা বানুর কাছে ছুটে যান। বেদানা হাতে পেয়ে অবাক হামিদা জানতে চান কোথায় পেলেন। সম্রাট জবাব দিলেন, ‘আমি হিন্দুস্তানের সম্রাট, আমার স্ত্রী একটি বেদানা খেতে চেয়েছে আমি তা এনে দিতে পারব না তা হয় না।’ বেগমদের ইচ্ছা পূরণ সম্রাটদের কাছে রাজ্য জয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই হামিদা বানু যিনি হুমায়ুনের স্ত্রী ও আকবরের মা একদিন হয়ে ওঠেন মহলের সর্বেসর্বা। তার কথা অমান্য করার সাহস কারোরই ছিল না। লাভ করেন ‘মরিয়ম মাখানি’ উপাধি, অর্থ ‘মেরির সঙ্গে বসবাস’। পুত্র আকবরের ওপরও হামিদা বানুর প্রভাব ছিল অপরিসীম। এমনকি সবচেয়ে বেয়াড়া শাহজাদা সেলিমও দাদিকে মেনে চলতেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের আরেক জটিল চরিত্র শাহাজাদা সেলিম। তার প্রপিতামহ বাবর সিংহাসনে বসেছিলেন এগারো বছর বয়সে, পিতামহ হুমায়ুন আসীন হয়েছিলেন বাইশ বছর বয়সে, আর সম্রাট হওয়ার সময় পিতা আকবরের বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ কিন্তু ত্রিশ বছর বয়স পার হওয়ার পরও সিংহাসনের উত্তরাধিকার না পেয়ে প্রায়ই পিতার আদেশ অমান্য করত শাহজাদা সেলিম। সেলিম মজেছেন অসংখ্য নারীর প্রেমে। সেলিম মহলের নর্তকী আনারকলির প্রেমে পড়লে বাধা হয় বংশমর্যাদা। কিন্তু সে বাধা ডিঙিয়ে আনারকলিকে পেতে সেলিম পিতা আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কারণ প্রেম যে সাম্রাজ্যের চেয়েও বড়। শাহজাদা সেলিম শুধু আনারকলির প্রেমেই অন্ধ ছিলেন না। তার এক প্রিয় স্ত্রী ছিলেন নূরজাহান। নূরজাহানকে বলা মুঘল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী। নূরজাহানের আসল নাম মেহের-উন-নিসা। তিনি ছিলেন পারস্যের সম্রাট মির্জা গিয়াস বেগের কন্যা। অপরূপ সুন্দরী মেহের-উন-নিসাকে বিয়ের পর সম্রাট সেলিম জাহাঙ্গীর তাকে উপাধি দেন ‘নূর-ই-জাহান’।
কথিত আছে, সেলিমের সঙ্গে আনারকলির প্রেম যেমন সম্রাট আকবর মানতে পারেননি, তেমননি মেহের-উন-নিসার সঙ্গে প্রেমও তিনি মেনে নেননি। শাহজাদা সেলিমের দুর্বলতার কথা জানতে পেরে সম্রাট আকবর মেহের-উন-নিসাকে নিজের বাহিনীতে কর্মরত ইরানী সমরনায়ক আলী কুলি খানের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাদের বর্ধমান পাঠিয়ে দেন। কিন্তু শাহজাদা সেলিম আগ্রার সিংহাসনে বসেই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে আলী কুলি খানকে হত্যা করে মেহের-উন-নিসাকে বিয়ে করে নিজের ‘নূরজাহান’ বানান। নূরজাহান শুধু সুন্দরী নন, ছিলেন বিচক্ষণ। বিয়ের পর তিনি তার পিতাকে দরবারে প্রধান দেওয়ান পদে উন্নীত করেন। খান-ই-সামানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আনেন ভাই আসফ খানকে। এই আসফ খানেরই মেয়ে ছিলেন মমতাজ মহল। যার সঙ্গে সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র ও পরবর্তী সম্রাট শাহজাহানের বিয়ে হয়। নিজের ভাতিজিকে শাহজাদী করার পর নূরজাহানের প্রথম স্বামী আলী কুলি খানের ঘরে জন্ম নেওয়া মেয়ে লাডলী বেগমের সঙ্গে সম্রাটের আরেক পুত্র শাহরিয়ারের সঙ্গে বিয়ে দেন। পরবর্তী সময় নিজ মেয়ের জামাই শাহরিয়ারকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার করতে নূরজাহান সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। ১৬২২ সালে কান্দাহার দুর্গ পারস্যের শাসক অবরোধ করলে শাহজাদা শাহজাহানকে কান্দাহার পাঠিয়ে নিজ জামাতা শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসানোর পরিকল্পনা ছিল নূরজাহানের। যেটি ফাঁস হয়ে গেলে শাহজাহান কান্দাহার যাননি।
সম্রাট সেলিম জাহাঙ্গীরের পিতা সম্রাট আকবরের সঙ্গে রাজস্থানের রাজপুত বংশের হিন্দু মেয়ে যোধাবাইকে বিয়ে করেন। তিনি প্রাসাদের মধ্যে নিজ ধর্ম পালন করতেন। ফতেরপুর সিক্রিতে তার সৌজন্যে নির্মাণ করা হয় ‘যোধাবাই মহল’। যেখানে ছিল মন্দির ও তুলসী গাছ। এই যোধাবাই হলেন সম্রাট সেলিম জাহাঙ্গীরের মা। সেলিম জাহাঙ্গীরের পুত্র সম্রাট শাহজাহানও প্রেমে কম যান না। তার প্রেমের অমর কীর্তি তাজমহল আজও যমুনা তীরে স্বগৌরবে উজ্জ্বলমান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সন্তান প্রসবকালে মৃত্যুবরণ করা সম্রাজ্ঞী মমতাজ মৃত্যুশয্যায় সম্রাটকে বলেছিলেন, ‘জাঁহাপনা, আমার ইন্তেকালের পরে আমার কবর ঘিরে এমন এক সমাধিসৌধ নির্মাণ করবেন, যার তুলনা আজও পৃথিবী দেখেনি।’ সম্রাট কথা রাখতে গিয়ে নির্মাণ করেন আজকের তাজমহল। মুঘল বংশে কথা না রাখা অমার্জনীয় অপরাধ ছিল।
মমতাজের মৃত্যুর পর তার কন্যা শাহজাদী জাহানারা মহলে ‘বাদশাহ ই বেগম’ হয়ে ওঠেন। এই পদটি মুঘল সাম্রাজ্যে সম্রাটের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী ধরা হতো। অনেকটা আজকের ফাস্ট লেডি পদের মতো। স্ত্রী শোকে কাতর শাহজাহান যখন সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন তখন ১৭ বছর বয়সী শাহজাদী জাহানারা সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও পররাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত দিতেন। আজকের দিল্লির লালকেল্লা, জামে মসজিদসহ প্রায় ১৯টি প্রাসাদ নিয়ে সে সময় ‘শাহজাহানবাদ’ নামে শহর গড়ে তোলা হয়েছিল, তার তত্ত্বাবধান করতেন জাহানারা। সুরাত বন্দরের রাজস্ব আসত তার নামে। জাহানারার ভাই শাহজাদা আওরঙ্গজেবের শাসনকালে মতের বিরোধ থাকা সত্ত্বেও মহলে তিনি ছিলেন মর্যাদাবান ও প্রভাবশালী। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন ‘বাদশাহ ই বেগম’। প্রজাদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় ও মহানুভব জাহানারার শেষ ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুর পর তাকে হজরত নেজামুদ্দিন আওলিয়ার সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়।
শাহজাদা সেলিমের সঙ্গে আনারকলির প্রেমকে বলা হয় প্রাসাদ কাঁপানো প্রেম। পঞ্চাশের দশকে শাহজাদা সেলিমের সঙ্গে আনারকলির প্রেম নিয়ে বলিউডে নির্মিত হয় সাড়া জাগানো সিনেমা ‘মুঘল ই আজম’। সিনেমা সেটে তৈরি হয় আরেক প্রেমের মহাকাব্য। এই সিনেমায় আনারকলি চরিত্রে অভিনয় করেন মধুবালা। মধুবালার সৌন্দর্যের কথা কান্দাহার থেকে ঢাকা সবখানে আলোচিত ছিল। হলিউডের মেরিলিন মনরোর সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করা হতো তাকে। দিল্লির মেয়ে মধুবালার আসল নাম ছিল মমতাজ জাহান বেগম। সে মমতাজের প্রেমে মজেছেন দিলীপ কুমার থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টো পর্যন্ত। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রায়ই মুম্বাইতে তাদের পারিবারিক বাগান বাড়িতে থাকতেন। উদ্দেশ্য মুঘল ই আজম সিনেমার শুটিংয়ে সেটে এসে মধুবালাকে দেখা। এক সময় ভুট্টো বিয়ের প্রস্তাবও দেন মমতাজ জাহান বেগম ওরফে মধুবালাকে। এমনকি দিলীপ কুমারও বিয়ে করতে চেয়েছিলেন মধুবালাকে।
উপমহাদেশের প্রভাবশালী পুরুষদের প্রেম মহাকাব্য চিরন্তন। তাদের বিবিদের প্রতি তাদের ভালোবাসাও ছিল অসীম। সে ভালোবাসা বিবিদের প্রায়ই নিয়ে এসেছে ক্ষমতার মসনদে। কখনো অন্দরমহল থেকে কখনো সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে তারা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রেম ও সাহিত্য অনুরাগে সাবেক সেনাশাসক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের তুলনা সেই মুঘল আমলের সঙ্গেই করা যেতে পারে। তার মৃত্যুর আগে জাতীয় পার্টি নামক সাম্রাজ্যের পরবর্তী সম্রাট কে হবে তা নিয়ে প্রাসাদের অভ্যন্তরণে নানা সমীকরণ হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি তার ভাই জিএম কাদেরকে পরবর্তী ‘সম্রাট’ ঘোষণা করেন। কিন্তু আলোচনায় থেকে যান ‘বাদশাহ ই বেগম’ বেগম রওশন এরশাদ। আলোচনা আছে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতার সময় বেগম রওশন এরশাদের ইচ্ছার বিশেষ সমাদর হতো, যেভাবে মুঘল দরবারে বিবিদের সমাদর ছিল। এরশাদের শাসন আমল হয়ে এখন সাবেক আমলা জিএম কাদেরের হাতে থাকা জাতীয় পার্টিতে বিবিদের বিশেষ মর্যাদা মুঘল দরবারের মতোই বহাল আছে। আলোচনা আছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে জেনারেল এরশাদকে ভোটের মাঠে নিতে প্রভাবিত করেছেন বিবি রওশন এরশাদ। সম্প্রতি দেশ রূপান্তর একটি সংবাদ ছেপেছে, সেখানে বলা হচ্ছে জিএম কাদের নির্বাচনে যেতে অনাগ্রাহী ছিলেন। কিন্তু শেরিফা কাদের নিজের জন্য ঢাকা-১৮ আসনটি নিশ্চিত হয়ে স্বামীকে নির্বাচনে যেতে প্রভাবিত করেন। জিএম কাদেরের গুরুত্বপূর্ণ ভারত সফরে ছিলেন শেরিফা কাদের। ২০২১ সালের আগের অপরিচিত মুখ শেরিফা কাদেরকে এক কাগজের স্বাক্ষরে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য করেছেন জিএম কাদের। এ যেন মুঘল দরবারের বিবি প্রেমের আরেক দৃশ্যায়ন। হামিদা বানু সম্রাট হুমায়ুনের কাছে চেয়েছিলেন বেদানা, মমতাজ শাহজাহানের কাছে চেয়েছিলেন তাজমহল আর জাতীয় পার্টির বেগমরা তাদের ‘সম্রাট’দের কাছে চান সংসদের আসন, পার্টির প্রেসিডিয়াম পদ।
দেশ রূপান্তর খবরে আরও বলছে, বহিষ্কৃত মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা সংসদ সদস্য হলেও তার স্ত্রী প্রয়াত রাকিবা নাসরিনের প্রভাব ছিল। রাঙ্গা তার স্ত্রীর কথায় পরিচালিত হতেন। দলের সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও বড় প্রভাব রয়েছে তার স্ত্রী ও সংসদ সদস্য নাসরিন রত্নার। তবে বেগমদের ক্ষমতার লড়াই এখনো শেষ হয়নি। নূরজাহান যেমন শাহরিয়ারকে উত্তরাধিকারী করতে চেয়েছিলেন, তেমনি রওশন এরশাদ চান সাদ এরশাদকে জাতীয় পার্টির পরবর্তী ‘সম্রাট’ ঘোষণা করতে। এরশাদের অপর স্ত্রী বিদিশা বলছেন তিনি এবং তার ছেলে এরিকও সিংহাসনের দাবিদার। তবে রওশন ও বিদিশাকে হারিয়ে অন্দরমহল থেকে জাতীয় পার্টির সিংহাসনের সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হতে যাচ্ছেন শেরিফা কাদের। যিনি হতে যাচ্ছেন এই যুগের জাতীয় পার্টির নতুন ‘বাদশাহ ই বেগম’। হতে চান আরেকজন ‘নূরজাহান’ বা ‘জাহানারা’। মুঘল দরবারে নারীদের ইতিবাচক প্রভাবও ছিল। ‘বাদশাহ ই বেগম’ নূরজাহান নিজের বাবা ও ভাইকে মহলে প্রতিষ্ঠিত করে আখের গোছালেও শাহজাদী জাহানারা কঠিন সময়ে শক্ত হতে সাম্রাজ্য সামলেছেন। সাম্রাজ্যের রাজস্ব বাড়িয়েছেন। সাজিয়েছেন নতুন শহর শাহজাহানবাদ (পুরান দিল্লি)। তবে জাতীয় পার্টির বেগমরা ‘নূরজাহান’ নাকি ‘জাহানারা’ তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মুঘল দরবারে বড় সাংস্কৃতিক আয়োজনকে বলা হতো ‘জুশনে-ই জুলুস’। জাতীয় পার্টির বেগমরা যেভাবে অন্দরমহল থেকে কলকাঠি নাড়ছেন কেউ কেউ তাকে বলছেন ‘জুশনে-ই তামাশা’।
লেখক: কলামিস্ট
shahadatju44@gmail.com
ভয়েস/আআ