রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৩:৫৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে বজ্রপাত

নাজমুল আহসান:
দুর্যোগপ্রবণ হিসেবে বিশে^ বাংলাদেশের পরিচিতি আছে। মূলত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জান ও মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের এই পরিচিত গড়ে উঠেছিল। তবে আশার কথা, দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা এখন বিশ্ববাসীর কাছে দৃষ্টান্ত। নতুন আপদ জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাবাহিক ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব। দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়লেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২-এর সিলেটের নজিরবিহীন বন্যা আমাদের স্মৃতিতে এখনো অকপটে ধরা দিচ্ছে। তবে আরও আশঙ্কার বিষয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নতুন নতুন আপদ ধীরে ধীরে মারাত্মক বিপদ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে বজ্রপাতের হুমকি সম্পর্কিত একটি সংবাদ প্রকাশ করে বিবিসি। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বজ্রপাতের বৃদ্ধির প্রবণতার সঙ্গে মূলত জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর পেছনে জনসচেতনতার অভাব ও ব্যবস্থাপনা দুর্বলতাকে দায়ী করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কোনো কোনোটা দুর্যোগ আকারে সহসাই ধরা দেয়, আবার কোনটা ধীরে ধীরে আপদ থেকে মারাত্মক দুর্যোগ হয়ে উঠে মানুষের জীবনধারণকে অসম্ভব করে তোলে। এ রকম ধীরে ধীরে নিঃশেষ করা আপদের মধ্যে রয়েছে অঞ্চলভেদে একদিকে মরুকরণ ও অন্যদিকে উপকূলে লবণাক্তকরণ প্রক্রিয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশে অতিপরিচিত দুর্যোগগুলোর মধ্য রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী খরা, বন্যা, পাহাড়ি ঢলজনিত হঠাৎ বন্যা, ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। বিবিসির ওই প্রতিবেদন তথ্য ও উপাত্তের ব্যবহার করে বলছে, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রকোপ বাড়ছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয় যা বিশে^র অন্যতম সর্বোচ্চ। জানা যায়, ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সেই কয়েক ডজন থেকে সাম্প্রতিক সময় কয়েকশতে পৌঁছেছে। এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল এক দিনেই বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের ছয়টি উপজেলায় বজ্রপাতে ৯ জন প্রাণ হারান। এর কদিন পরই ২৭ এপ্রিল ছয় জেলায় বজ্রপাতে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে বজ্রপাতে কমবেশি ২৬৫ জনের মৃত্যু হয় এবং গত এক যুগে প্রায় তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে। তথ্যমতে, বজ্রপাতের কারণে ২০২১ সালে মারা গেছে ৩৬৩ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন এবং ২০১৫ সালে ১৬০ জন। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত বছর (২০২৩) ৯ মে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক কর্র্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কমে এসেছে, কিন্তু অতি উষ্ণতা ও বজ্রপাতের মতো নতুন ধরনের দুর্যোগে মৃত্যু ও বিপদ বাড়ছে। এই প্রতিবেদনে আরও বলেছে বাংলাদেশের ৮৩ শতাংশ মানুষ সারা বছর এ ধরনের কোনো না কোনো জলবায়ু দুর্যোগের শিকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ বজ্রপাত ও বজ্রপাতের কারণে মৃত্যু দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। বজ্রপাতের বৃদ্ধি অধিক মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী তবে অনেকেই মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে নির্বিচারে বৃক্ষনিধনকে দায়ী করেন। প্রয়োজনীয় বৃক্ষ না থাকার কারণে মেঘে উৎপাদিত বিদ্যুৎ খোলা জায়গায় মানুষকে আঘাত করে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র (নাসা), জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধি। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছন বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পরিবেশগত বিপর্যয়, জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন এসবগুলো ফ্যাক্টরই দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বজ্রপাত বৃদ্ধির যোগ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশে^ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই জলীয়বাষ্পই বজ্র-ঝড় ও বজ্রপাতের প্রধান শক্তি। তাপমাত্রা যত বাড়বে জলীয়বাষ্প বা এ ধরনের শক্তিও তত বাড়বে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো ভারতেও বজ্রপাত বাড়ছে, তবে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে সেখানে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বজ্রপাত নিরসনে বাংলাদেশেও বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে তার সুফল এখনো খুব একটা পাওয়া যায়নি। পরিবেশকর্মীরা বজ্রপাত নিরসনে বৃক্ষরোপণের কথা বলেছেন, যাতে বজ্রপাতের প্রভাব মানুষের ওপর না পড়ে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে বৃক্ষনিধন বেশি সেসব অঞ্চলে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। তবে এর সুফল পেতেও সময় লাগবে। এর আগে (২০১৭-১৮ সালে) সরকারের পক্ষ থেকে এক কোটি তাল গাছ লাগানোর একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। সে সময় বেশ কিছু তালের বীজ রোপণ করা হয়, কিন্তু এই প্রকল্পের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, তারপরও তাল একটি কম বর্ধনশীল গাছ, এর সুফল পেতে দুই থেকে তিন দশক লেগে যাবে। অন্যদিকে এই সংকট থেকে আশু মুক্তি পাওয়ার জন্য বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র এবং খোলা জায়গায় কৃষকদের জন্য বজ্রপাত নিরোধক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা দরকার। সর্বোপরি বজ্রপাতের এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি করার জরুরি।

আমাদের দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হতো। আমরা জানি, বজ্রপাতের পেছনে বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ সম্পর্ক যুক্ত আছে। জলবায়ু পরিবর্তন সেই কার্যকারণ সম্পর্ক আমাদের জন্য যেন অভিশাপ হিসেবে ধরা দিচ্ছে। বিভিন্ন দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা এখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত আমাদের সেই অভিজ্ঞতাকে এখন বজ্রপাতে মৃত্যু কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কত তাড়াতাড়ি তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব, আদৌ পাব কি?

লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট

psmiraz@yahoo.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION