রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৪:৪৭ পূর্বাহ্ন
উম্মে রায়হানা:
সাংবাদিকতা শিক্ষার্থীদের জন্য এক সময় একটি অবশ্যপাঠ্য পুস্তক ছিল ‘গণমাধ্যম ও জনসমাজ’। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ইতিহাস ও বিকাশের একটি চিত্র পাওয়া যায় এই বইটিতে। এখনো গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা এই বইটি পড়েন কি না, বা শিক্ষকরা পড়তে বলেন কি না তা আমার জানা নেই। পড়লেও বা পড়ালেও তা খুব প্রাসঙ্গিক হয়তো হবে না। কেননা, মিডিয়া বুম বা গণমাধ্যম বিস্ফোরণের এই যুগে এসে দেখা যাচ্ছে যে যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আর গণমানুষকে ধারণ করছে না, বরং হয়ে উঠেছে গুটিকয় মানুষের প্রচারের পরিসর। সে হিসেবে হয়তো ‘গণমাধ্যম’ শব্দকে বদলে প্রচারমাধ্যম বলাটাই বেশি যথাযথ হয়। এ বিষয়ে পণ্ডিতরাও অনেকেই একমত। বলা বাহুল্য, মিডিয়া এখন আর আগের মতো ছাপা পত্রিকা, টেলিভিশন ব্রডকাস্ট এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে সীমাবদ্ধ নেই। এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং এর নানা প্রকার শাখা-প্রশাখা, যেমন টিকটক, ইমো ইত্যাদি। এর ফলে গণমানুষের স্বর কতখানি বেড়েছে তা স্পষ্ট না হলেও প্রচারেই প্রসার এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাসীদের যে রমরমা দশা সৃষ্টি হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে নানা প্রকার মাধ্যমের প্রচার ও প্রসার থামিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মূলধারার সংবাদ মাধ্যম, বিনোদন মাধ্যম তথা প্রচার মাধ্যমগুলো ছুটছে সেই একই পথে। যে পথে গিয়েছে সামাজিক মাধ্যমের বিনোদন প্রচারকরা।
বিনোদন সংবাদের মোড়কে হাজির হওয়া সংবাদমূল্যবিহীন তথ্য, সাজানো বিষয়-আশয় এবং যৌনতা ও নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিষয়ক খবরে ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। মানুষের রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে গেলে যেমন রক্তকণিকা ভারী হয়ে যায়, শ্লথ হয়ে যায়, তেমনি বিনোদনের ভারে সামাজিক মাধ্যম এবং ব্যবসা বাড়ানোর ধান্দায় মূলধারার প্রচার মাধ্যমগুলোও হয়ে উঠেছে ভীষণ ভারী, গতিহীন ও নিরর্থক। এখানে মূলধারার প্রচার মাধ্যমগুলোর দিকে আঙুল তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে টিভি মিডিয়াগুলো যখন বিনোদন সংবাদের নামে তথাকথিত তারকাদের (এবং অ-তারকাদেরও) ব্যক্তিগত ও যৌনতা বিষয়ক খবরাখবর যত্নের সঙ্গে প্রচার ও ফলোআপ করতে থাকে তখন বিষয়গুলো সংবাদ মর্যাদা পেয়ে যায় সহজে, কেননা টিভি অনেক বেশি মানুষ দেখে, যত মানুষ পত্রিকা পড়ে তার চেয়ে বেশি তো বটেই। এই রকম ব্যক্তিগত বিষয়কে খবরের কাতারে নিয়ে এসে মিডিয়ার আলোর তলায় নিজেকে মেলে ধরা শুরু করেছিলেন সম্ভবত চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে এসে তিনি নিজের যৌন তথা দাম্পত্য জীবন নিয়ে ‘বিস্ফোরক’ তথ্য ‘ফাঁস’ করেন। এর পর থেকেই সম্ভবত বিষয়টি ট্রেন্ড হয়ে যায়। আগে কেউ কোনো যৌক্তিক দাবি-দাওয়া থেকে থাকলে প্রেস কনফারেন্স করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এখন মানুষজন টিভি মিডিয়ায় এসে এই কাজটি করেন সাক্ষাৎকার দিয়ে। এই করতে করতে পুরো মিডিয়া কেমন করে একটা হাইপাররিয়েলিটি তৈরি করে ফেলল সে এক দেখবার মতন বিষয়। একবার মরিয়ম মান্নান বলে এক নারী তার মাকে হারিয়ে ফেলে অনেক কান্নাকাটি করে যখন নিজের মাকে মৃতই বানিয়ে ফেলল, তখন দেখা গেল সেই মা বেঁচে আছেন। সাম্প্রতিকতম সময়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার শিট ছিঁড়ে ফেলা নিয়ে এক সাজানো নাটক। এই কাতারে এখন সবাই তারকা বা সাধারণ মানুষ, বিখ্যাত বা কুখ্যাত, বিপদাপন্ন বা নিরাপদ সবাই তৈরি করছে সংবাদ। কোথায় সত্যের শেষ আর মিথ্যার শুরু তা স্পষ্ট নয় কারও কাছেই।
আপাতদৃষ্টিতে সংবাদ মনে হলেও এই ঘটনাগুলো প্রকৃতপক্ষে সংবাদ না, সেটাও সবচেয়ে বড় সংকট নয়। টিকটক তারকা বা ফেসবুক রিলসগুলোকে পাত্তা না দিলেও চলে। কিন্তু প্রকৃত সংকট হচ্ছে এই যে, এই সব অর্ধসত্য আধা-সংবাদের আড়ালে অপরাধীরা সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে জাতিকে খাইয়ে দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে এবং এই সব আলোড়নের আড়ালে প্রকৃত সংবাদ কোণঠাসা হচ্ছে! এবং এই পুরো প্রক্রিয়ায় মিডিয়ার ভূমিকা ভীষণ স্বার্থপরের মতো, ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন, জনবান্ধব নয় কোনোভাবেই। এ প্রসঙ্গে কারডিওলজিস্ট ডা. সাবরিনা, যিনি কভিডের সময় গণশত্রু হিসেবে গ্রেপ্তার হন এবং একটি স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি একাধিক অল্পবয়সী নারীকে যৌন নিপীড়নের দায়ে সন্দেহভাজন এই দুজনের নাম চলে আসে। এরা দুজনেই বইমেলায় বই প্রকাশ করে আলোচনায় এসেছেন। বই লেখার এবং প্রকাশ করবার অধিকার সবারই রয়েছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা এরা দুজনেই নিজেদের অন্যায় ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করছেন। মিডিয়াগুলোও হিট হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে নেমে পড়েছে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই।
এতে করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মানুষ দেখতে পাচ্ছেন না। যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দেখলাম, ময়মনসিংহ শহরের। আমার জন্ম ময়মনসিংহ শহরে এবং স্কুল-কলেজে পড়া, কিন্তু আমি ওই শহরের বেশি লোকজন চিনি না। যে কয়জন মানুষকে চিনি তার মধ্যে একজন শামীম আশরাফ। ময়মনসিংহের ব্রাহ্মপল্লীতে, আমার বাবার বাড়িতে, আমি গত এক বছর ছিলাম। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে আমার প্রিয়বন্ধু কবি ও শিল্পী রাজীব আশরাফ মারা গেলে আমি রাজীবের একটি ছবি আর ওর কিছু কবিতার লাইন বড় করে ছেপে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার সামনে টানিয়ে রাখি। সেই পোস্টারটির ডিজাইন আর ছাপার কাজ করে দিয়েছিলেন শামীম আশরাফ। শামীম গ্র্যাফিটি নামের একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চালান, নানা ছাপাছাপি আর ডিজাইনের কাজ করেন। জীবিকার জন্য এসব করলেও আদতে তিনি একজন কবি। শামীম যে সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, ‘বীক্ষণ’ সেখানে গত কয়েক বছরে কোনো শুক্রবারে সাহিত্যসভা মিস হয়নি।
দিন কয়েক আগে এই শামীম আশরাফের খবর দেখতে পেলাম কাগজে। তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাকে আটক অথবা গ্রেপ্তার করা হয় তার আগে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শহরের মেয়র ইকরামুল হক টিটোর বিরুদ্ধে পোস্টার ছেপেছেন। শামীম শহরের মানুষের নানা দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেছেন বটেই, কিন্তু‘ তাতে মেয়রের অসম্মান হয় কী করে! শামীম যা বলেছেন, তা যে কত সত্য তার সাক্ষী আমি নিজেই দিতে পারি। গত বছরের অক্টোবর মাসে ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঢাকায় চলে আসার পরদিন আমি শুনতে পাই, আব্বার বাড়ির নিচতলার যে ফ্ল্যাটে আমি থাকতাম সেখানে কোমর পানি। সেই পানিতে আমার বইপত্র আসবাব তৈজস সব ডুবে গিয়েছে। বন্যার পানি নয়, শহরের জলাবদ্ধতার নোংরা পানি।
আমাদের বাড়িটার বয়স তেত্রিশ, গত তেত্রিশ বছরে এরকম কোনো ঘটনার কথা আমার জানা নেই। এই ঘটনা যে অপরিকল্পিত উন্নয়নের চাপে ঘটেছে তা বুঝতে হলে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যে শহরের পাশেই একটা মৃত নদ হলেও, চলমান জলধারা আছে, সেখানে এমন জলাবদ্ধতা হওয়া প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক হতেই পারে না। কাছাকাছি সময়ে, এই ফেব্রুয়ারি মাসেই, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ঋদ্ধ এবং অমর্ত্যকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করবার আদেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বঙ্গবন্ধুর ছবি মুছে নতুন গ্রাফিতি এঁকেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে। এতে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা হয়েছে।
…শোনা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ছবি মোছা নয়, সাম্প্রতিক সময়ে চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়াই ছিল ঋদ্ধ আর অমর্ত্যর দোষ! সেই আন্দোলনে আরও অনেকেই অংশ নিয়েছেন, এক দুই করে তাদের প্রত্যেকের দিকে যে কোনো না কোনো অভিযোগের তীর ছুটে আসবে না তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। ভিন্নমত প্রকাশ করা বা যে কোনো অনিয়ম, যেমন শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন করতে না পারা, ক্যাম্পাসে নারীর নিরাপত্তা দিতে না পারা, সরকার এবং/অথবা প্রশাসনের দায় নিয়ে কথা বললে, জবাবদিহি চাইলে তাদের যেতে হচ্ছে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে। অথচ প্রচার মাধ্যমে এই খবরাখবরগুলো তেমনভাবে আসছে না। শামীম বা ঋদ্ধ বা অমর্ত্যর কোনো সাক্ষাৎকার আমার চোখে পড়েনি। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই করেছে, খুঁজলে পাওয়া যেতেও পারে। কিন্তু ওয়েব ভেসে যাচ্ছে, মুশতাক-তিশা, ডা. সাবরিনার মতো নারীর বিরুদ্ধে যৌন এবং জনগণের বিরুদ্ধে প্রবঞ্চনা ও জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার মতো অপরাধের সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত গল্পে। শামীম, ঋদ্ধ অথবা অমর্ত্যর মতন অন্যায়ের প্রতিবাদে আগুয়ান হয়ে ক্ষমতার বিরাগভাজনদের শক্তি ও সাহসের গল্পগুলো সামনে আসছে না। এই খবরগুলো সামনে এনে ক্ষমতার অন্যায় চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বার্তা জনমনে পৌঁছে দিচ্ছে না মিডিয়া। বরং, অন্যায় করে বড় গলায় সত্য মিথ্যা গুলিয়ে ফেলে জনসমাজকে বাঁদর নাচ দেখিয়ে ভুলিয়ে পকেট কেটে নেওয়াতেই সাহায্য করছে বিস্ফোরিত আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলো।
লেখক: কবি ও লেখক
ummerayhana@gmail.com
ভয়েস/আআ