রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১২:৫৫ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

রমজান দ্রব্যমূল্য সংযম

জাকির হোসেন:
জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তিনি জানান, বর্তমান সরকার জনগণের সরকার। জনগণের কষ্ট লাঘবে সরকার সবসময় সচেষ্ট। এ লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সব প্রকার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার। আসন্ন রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এদিকে রোজার আগেই বেড়েছে খেজুর, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, মুরগির দাম। দাম বাড়তে পারে কাঁচামরিচ, লেবু, বেগুন, শসা, টমেটোর। এই পণ্যগুলো রোজার ইফতারির খাদ্য তালিকায় থাকে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্যোগ কতটুকু স্বস্তি দিতে পারবে সাধারণ মানুষদের তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে গত দুবছর ধরে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। অনেক সিন্ডিকেটেরও সন্ধান মিলেছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে বলে সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে কার্যত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেই রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ। যা আগের মাসের চেয়ে বেশি। যদিও আমাদের দেশের মানুষের মূল্যস্ফীতির সহ্যক্ষমতা ৬ শতাংশের ঘরে।

নতুন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে মূল্যস্ফীতিকে টার্গেট করেছে বর্তমান সরকার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অঙ্গীকার করেছে। এরই মধ্যে ভোট শেষে শপথ নিয়েছে নতুন সরকার। এ কারণে আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি কমাতে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। অপরিশোধিত সয়াবিন, পরিশোধিত/অপরিশোধিত পাম তেল আমদানিতে আমদানি পর্যায়ে ১০% এবং উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত সমুদয় ভ্যাট হতে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। রমজানে খেজুরের চাহিদা বিবেচনায় খেজুর আমদানিতে শুল্কায়নের ক্ষেত্রে যৌক্তিক মূল্যকে ভিত্তি ধরে শুল্কায়ন করা এবং কাস্টমস শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক রহিত করতে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরোপণীয় আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিবেচনায় পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্কহার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। চাল আমদানিতে আরোপনীয় আমদানি শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং রেগুলেটরি ডিউটি ২৫%-এর পরিবর্তে ৫% নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার স্বার্থে।

রোজায় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার স্বার্থে ভারত সরকারের কাছে ১ লাখ টন চিনি এবং ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ সরবরাহের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রমজান মাস উপলক্ষে নিম্ন আয়ের মানুষের নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে ঢাকা মহানগরীর ২৫টি স্পটে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে সুলভমূল্যে দুধ, মাংস ও ডিম বিক্রির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পবিত্র রমজান উপলক্ষে আমদানি সংশ্লিষ্ট শুল্ক স্টেশনগুলো ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মসুর ডাল ও খেজুর দ্রুত খালাসকরণে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরও অনেক বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যা থেকে বোঝা যায়, সরকার এবার রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে বদ্ধপরিকর। তারপরও আশঙ্কা, ব্যবসায়ীরা এ সময় মুনাফাভোগী মনোবৃত্তি ছাড়তে পারবে কিনা? কারণ ইতিমধ্যে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

৫ বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চলছে। ২০২২ সালে ৬ শতাংশের ঘরের মূলস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে ছুঁয়েছে। এরপর থেকে বাড়া-কমার মধ্য দিয়ে গেলেও মূল্যস্ফীতি থাকছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এর কারণ হিসেবে করোনা-পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের এ অজুহাত সব ক্ষেত্রে সঠিক নয়। তাদের মুনাফাবৃত্তির মনোবৃত্তিও এর জন্য দায়ী। বিভিন্ন সময়ে পেঁয়াজ, আলু, মুরগি, ডিমের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিই তা প্রমাণ করে। এসব সিন্ডিকেটভিত্তিক কারবারিরা প্রশাসনের সামনেই সব কিছু করেছে। কিন্তু ভোগান্তি হয়েছে সাধারণ মানুষের। ফলে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা আগ্রহ যাই থাকুক না কেন, ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রার মুনাফাভোগী মনোভাব দূর না হলে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় আসবে না।

আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী সুযোগ খোঁজেন। যদিও মুনাফা করাটাই ব্যবসায়ীর নীতি। কিন্তু অতি মুনাফা নীতি নয়। এটা অনৈতিক। ধর্মীয় দৃষ্টিতে তো পাপ। বিশ্বের বেশির ভাগ মুসলিম দেশে রমজান মাসে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয় নিত্যপণ্যের বাজারে। আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য বেছে নেয় এই রমজানকে। কিছু কিছু ব্যবসায়ী এই মাসের মুনাফা দিয়ে বছর জুড়ে চলতে চায়। কিন্তু বছর জুড়ে তো মানুষ না খেয়ে থাকে না। মাছ, মুরগি, ডিম, তেল, চাল, ডাল বছর জুড়েই মানুষ কিনছে এবং ভোগ করছে। ফলে ওই সব ব্যবসায়ীরা অতিমাত্রায় মুনাফার প্রত্যাশা করে বলেই রোজায় নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ায়। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জঘন্য অপরাধী ছাড়া কেউ-ই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি (মূল্য বৃদ্ধির আশায়) মজুদ করে না।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৪৭)। একই সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ী দাম বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্য মজুদ করে ও বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তাদের ওপর প্রিয়নবী (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, আমদানি পণ্য সরবরাহকারী ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং মজুদদার অভিশপ্ত হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৩) হজরত ওমর (রা.) আরও বলেন, আমি রাসুল (সা.)কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে (বা সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৫) অন্যায্যভাবে এ রকম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে হাদিস শরিফে আরও অসংখ্য হুশিয়ারি বর্ণিত হয়েছে। এ তো হাদিসের কথা। এই হাদিস মানার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুসলমানদের কি শৈথল্য আছে?

উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর পথ খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন সম্প্রতি ঢাকা সফর করা বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) আনা বেয়ার্দ। মূল্যস্ফীতি কমানোর ‘লড়াইয়ে’ বিশ্বব্যাংক সহযোগিতা করবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কিছু সংস্কার দরকার বলে আমরা মনে করছি। বিশেষ করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশকে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় মনোযোগী হতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমানো যায় সেই পথ তৈরি করতে হবে।’ তবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, এটি রাতারাতি কমানো সম্ভব নয়। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতি রাতারাতি কমবে না। রমজানের পর থেকে বিশেষ করে মে-জুন মাসের দিকে কমে আসবে বলে আমরা আশা করছি। অর্থমন্ত্রী রমজান মাসের পর মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলেছেন আর প্রধানমন্ত্রী রমজান মাসে নিত্যপণ্যের বাজার সহনীয় রাখার উদ্যোগ নিতে বলেছেন।

অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার পার্থক্য কিছুটা থাকলেও বাজার পরিস্থিতি কিন্তু তার নিয়মেই চলছে। গত মাসে খেজুরের দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। ব্যবসায়ীরাই বলছেন ব্রয়লার মুরগির দাম রোজায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় ঠেকবে, যা বর্তমানে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ছোলা, চিনি, ডাল বেড়ে গেছে। পেঁয়াজের দাম সাধারণত এ সময় ৩০ টাকা কেজি থাকলেও এখন ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহেই বেড়েছে প্রায় ৩০ টাকা। চিনির দাম বেড়েছে ২০ টাকা। দাম আরও বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। তাহলে রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকল কোথায়?

এদিকে রমজান মাসের আগে বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য ইউনিট প্রতি ৭৫ পয়সা। ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর চলতি মাস থেকে বেড়েছে গ্রাহক পর্যায়ের বিদ্যুতের দাম। যার প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনযাত্রীয়। খাদ্যমূল্য এর বাইরে নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ার সুযোগটাও নেবে ব্যবসায়ীরা। সরকার রমজান মাসের পর বিদ্যুতের দাম বাড়ালে হয়তো ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দেখাতে পারত না।

রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হলে, সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কঠোর হতে হবে। নিয়মিত বাজার মনিটর করে পণ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে হবে। কৃত্তিম সংকট তৈরি করলে জেল জরিমানা করা যেতেই পারে। সেটা যে কোনো মাপের ব্যবসায়ী হোক না কেন। সরকারের মন্ত্রী যদি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি রাতারাতি কমবে না। রমজানের পর থেকে বিশেষ করে মে-জুন মাসের দিকে কমে আসবে’ তাহলে ব্যবসায়ীরা তো রমজান মাসে অতি মুনাফা করতেই চাইবে। তারা দ্রব্যমূল্য কমাবে কেন? মন্ত্রী তো সুযোগ করেই দিলেন রমজান মাসে অতি মুনাফা করার। ফলে শুধু ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করলেই হবে না। সরকারি যন্ত্রগুলোকেও রমজানের সংযমে উৎসাহিত হতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক

zakpol74@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION