রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০২:০০ পূর্বাহ্ন
মোস্তফা কামাল
পঁচাত্তরের পর দেশে যত নির্বাচন হয়েছে, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুষ্ঠু, অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছে এবারের নির্বাচন। আর এর কৃতিত্ব জেলা প্রশাসকদের। বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের এ কৃতিত্ব দিতে কোনো রাখঢাক করেননি প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন প্রকাশ্যে। তার কার্যালয়ের শাপলা হলে জেলা প্রশাসকদের চার দিনের সম্মেলন উদ্বোধনকালে। এ সময় ডিসিদের বিপুল করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে সম্মেলনস্থল। উপস্থিত মন্ত্রীসহ অন্যরাও মুখ-মাথা নেড়ে হাততালিতে শরিক হন। ডিসিরা নির্বাচনটি তুলে আনাতেই তো তারা মন্ত্রী-এমপি।
এবারের নির্বাচনের আগে কয়েক ডিসি-এসপির, কোথাও কোথাও ওসিদেরও অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠা নিয়ে সমালোচনা ছিল। তা বেশির চেয়েও বেশি হয়ে গেছে মনে করা হয়েছে। জোশে বা ঠেলায় তারা ভীমরতিতে পড়েছেন বলে মূল্যায়ন করেছিলেন। কয়েকজনকে এই ‘বেশি বেশি’ তৎপরতার অপরাধে বদলিও করে দেওয়া হয়েছিল।
এবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে পয়লা রাতেই আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে শেষ করে দেবে বলে আশঙ্কা জানিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। স্বাভাবিকভাবেই বাদবাকি রাতগুলোতে আরও কী হবে এ ভয়ানক প্রশ্ন দেখা দেয়। তাই যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। নৌকাকে জেতাতেই হবে। এমন অবস্থার মধ্যে বিশেষ এবং ব্যাপক নড়াচড়া দেখা দেয় প্রশাসনে। ক্ষেত্রবিশেষে তা দলের নেতাকর্মীদের চেয়েও বেশি। ক্ষমতাসীন দলই যেন ক্ষমতায় থাকে এ জন্য দোয়া-মোনাজাত করে ভাইরাল হন চট্টগ্রামের ডিসি মমিনুর রহমান। কয়েকজন ডিসির এমন তাড়নাবোধের মধ্যে তাদের টপকে যাওয়ার প্রতিযোগিতা দেখা দেয় ওসিদের মধ্যে। রাষ্ট্রীয় ইউনিফর্মে শরিক হয়ে দলীয় স্লোগান দিয়ে ভাইরালও হন কয়েক পুলিশ কর্মকর্তা।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোর্ট, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জসহ কয়েক থানার ওসির যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে জেতাতে হবে দেওয়া বক্তৃতাকে দেখা হয়েছে বিভাগীয় অপরাধ হিসেবে। তাদের কয়েকজনকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে অন্য থানায়। সেই বিবেচনায় নির্বাচন তুলে আনার কাজে ডিসিদের চেয়ে ওসিদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখা যায় না। এ সম্মেলনে ডিসিদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির আগে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে তাদেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। প্রশংসাও করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও তাদের কাছ থেকে ভূমিকা আশা করা হয়েছে। তবে, প্রত্যাশার সমান্তরালে ডিসিদের দায়িত্ব ও ক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে।
ওসি-ডিসিরা মাঠ প্রশাসনের বড় কর্তা। নির্বাচনের ফলাফলে ম্যাটার করেন। ক্ষমতাসীন দলের উপকারের পাশাপাশি বিরোধী দলকে ঘোল খাওয়ানোর ব্যাপক ক্ষমতা তাদের। তাদের কারও কারও মধ্যে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজনীতি করা বা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগাম চেষ্টা বেশ আলোচিত। চেয়ারে বা চাকরিতে থাকতেই তাদের সেটার নিশ্চয়তা মেলানোর সুযোগ আছে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে সেটার নমুনা দেখে অভ্যস্ত মানুষ। নেতা-এমপিদের অনেক কাজও এখন প্রশাসনের হাতে। কারও কারও শঙ্কা ছিল, আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন-বনেদি বিশাল দলের নেতাকর্মীরা তা মেনে নিতে চাইবে না। কারণ এ দলের নেতাকর্মীরা আমলাতন্ত্র বিদ্বেষী এবং একটু বেশি স্বাধীনচেতা। সেই শঙ্কা এরই মধ্যে অমূলক প্রমাণ হয়েছে। আমলাতন্ত্রের সঙ্গে কেবল মিলমিশ-আপস নয়, ক্ষেত্রবিশেষে ভাগযোগ ও বশ্যতায়ও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। দলীয়, সরকারি, রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যাপক শরিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের মধ্যে।
ডিসি সম্মেলনে সরকারের উন্নয়নকাজে তাদের আরও সম্পৃক্ত করার কথা এসেছে। গেল সপ্তাহেই জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে যেখানে-সেখানে আর প্রকল্প না নিতে। আর ডিসি সম্মেলনে ডিসিদের বলা হয়েছে সরকারি প্রকল্প দেখভাল করতে। যার যার এলাকায় ব্রিজ, সড়ক পরিবহনও দেখভালের আশা আছে ডিসিদের। বাজার তদারকি তো করবেনই। তাদের আসন্ন রমজানে খাদ্য মজুদ ও ভেজালের বিরুদ্ধে কঠোর হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তারা যার যার এলাকাভিত্তিক নজরদারি করবেন। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালো-মন্দ, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় অমনোযোগিতা, কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদিও থাকবে এ নজরদারির আওতায়। শেয়ান-চতুর এমপি-মন্ত্রী-নেতারা এর ফের বুঝে গেছেন। চেয়ে চেয়ে দেখছেন তাদের কাজ বা খবরদারিগুলো কীভাবে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বলার-করার কিছু থাকছে না, হাততালি আর মাথা নাড়া ছাড়া। একদিকে প্রশাসনের কর্তৃত্ব, আরেকদিকে টাকাওয়ালাদের দাপট হজম করা ছাড়া উপায় নেই। দল বা রাজনীতিবিমুখ হওয়ার অবস্থাও নেই। তা হবে দলের রাজনীতিতে আনফিট হয়ে যাওয়ার প্রমাণ।
দল ও সরকার আলাদা করার অলিখিত নীতি অনুসরণ করে আসছিল আওয়ামী লীগ। যে কারণে ২০১৪ সালে মন্ত্রিসভায় দলীয় পদে থাকা নেতার সংখ্যা কমে যায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এ নীতি অনুসরণ করায় দল না করেও অনেকেই আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে জনপ্রতিনিধি হন। বিশেষ করে টাকাওয়ালাদের কদর বেড়ে যায় স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে। এতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া থাকলেও প্রকাশ ঘটানো মানে বিপদ আমন্ত্রণ করা। এখন অলিখিত ওই নীতি থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ। এর প্রতিফলন সংসদে এবং নতুন মন্ত্রিসভায়ও। ব্যবসায়ী-আমলা-কামলার একটা সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা হলেও দলের কামলাদের হিস্যা সেখানে মামুলি। এরপরও আওয়ামী লীগ এখনো তুলনামূলক কর্মীবান্ধব দল। চালাক-চতুর বাস্তববাদী কর্মীরা হাল বুঝে পাল তুলছে। দলের ব্যবসায়ী-আমলাদের আয়ত্ত করে যদ্দুর সম্ভব নিজেদের পাওনা বুঝে নিচ্ছে। মনে কষ্ট থাকলেও এর মধ্যে তারা নতুন ধরনের আশা দেখছে। তাদেরও নিজস্ব একটা বুঝ আছে। যুগ বদলেছে। দলের কাঠামো-কৌশলও পাল্টেছে। নিজের ভাগে তুলনামূলক কম পড়লেও ব্যবসায়ী-আমলা ভরসায় দল ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় না থাকলে ভাগে এটুকুও পড়ত না এই বোধ-বুদ্ধির মাঠ নেতাকর্মীরা তাই হতাশ নন। এর মধ্যে মন্দের ভালো অনেক কিছু দেখছেন তারা।
বিশাল এ দলের নেতাকর্মীদের এমন বোধ-উপলব্ধিতে আনতে পারা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ জয়। তাদের বোঝানো সম্ভব হয়েছে বিএনপির দিকে তাকাতে। বিএনপির নেতাকর্মীদের দশা উপলব্ধি করতে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তাদের অবস্থা এখন আরও করুণ হতো! তার চেয়ে বড় কথা ২০১৪-১৮ এর চেয়ে এবার দলীয়দের বেশি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আমলা-ব্যবসায়ীদের গুরুত্বের পাশাপাশি এবার দলীয়দেরও যদ্দুর সম্ভব আমলে নেওয়া হয়েছে। অন্তত ১২ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে যারা একবারেই দলীয় কামলা, দলই তাদের ঠিকানা। তারাও দলের জন্য অন্তপ্রাণ। এর আগের টানা তিন মেয়াদে তা করা হয়নি। ২০১৪ সালের পরে দলীয় রাজনীতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি হতাশায় নিমজ্জিত হন। স্থানীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে কেন্দ্রেও নিগৃহীত হয়েছেন। দলে-সরকারে দুই জায়গায়ই উপেক্ষিত হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের সাইড লাইনে পড়ে গেছেন। ২০১৮ সালের পর তা চরম পর্যায়ে চলে যায়। এ সময় আওয়ামী লীগের কর্মী পর্যায়েও এ হতাশা ভর করে।
তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা পর্যন্ত গণমাধ্যমে ছড়িয়েছে। সেই তুলনায় এবার নমুনা ভালো। মন্ত্রিসভায় চৌদ্দ-আঠারোর চেয়ে রাজনীতিকদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনেও তা দৃশ্যমান। রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষার মূল্য দেওয়া হয়েছে।
মন্দের ভালো বিবেচনায় যা মানসিক শান্তির বাতাস দিচ্ছে মাঠের নেতাকর্মীদের। তাদের ফেসবুকেরও লুকও আপাতত বদলে গেছে। সবার নিউজফিডে ‘ওম শান্তি! ওম শান্তি!’ টাইপের সাইন ও আমেজ। এবারের ‘চান্সে’ না পেলেও ঠ্যালা-গুঁতো খেয়ে পরে এক সময় প্রাপ্তির আশা জাগছে। টাইট ফিটিং প্যান্ট বা পায়জামা খুলে লুঙ্গি ড্যান্স দেওয়ার অবস্থা হবেসেই শঙ্কা কেটে গেছে। তাদের আপাতত কাজ শুধু মিলিমিশে লেগে থাকা। কম-বেশিতে মন খারাপ না করে ভাগেযোগে টিকে থাকা। তাদের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে ২০১৪ আর ২০১৮ সালের পরিস্থিতি আর হবে না। ২০২৩ সালে দেশি-বিদেশি যে ষড়যন্ত্র উৎরাতে হয়েছে ভবিষ্যতে তাও আর হবে না।
নতুন বছরে কেবল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তাও সামলে নেওয়া যাবে। এর মূল শক্তি হবে দলের তৃণমূল। এই তৃণমূলকে দলে ও সরকারে পরিপূর্ণ সারপ্রাইজ দেওয়া হবে আগামীতে। যার শুরুটা হয়েছে মাত্র। আজকের কর্মীদের হাতেই তখন থাকবে যাবতীয় নেতৃত্ব। ব্যবসায়ী-আমলা শ্রেণি তখন দলের কর্মী হয়ে টিকে থাকলেই ধন্য হবে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মোটামোটি মিশনের মতো চলছে এ বিশ্বাস জাগানোর কাজ। নির্বাচন পরবর্তী এ সময়ে দলের সাংগঠনিক তৎপরতা ও রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করাকেই তাদের প্রধান এবং একমাত্র কাজ বলে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এ কাজে সাফল্যের লক্ষণ ও আশা দেখছে দলের শীর্ষ মহল। বাদবাকিটা ভবিষ্যৎ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
mostofa71@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর