রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৩:১৮ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক:
সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যা মামলার আসামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ‘ক্রসফায়ার’ মিশন শুরু করেন কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে। ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারী মহেশখালী থানায় ওসি হিসাবে যোগদানের পর শুরু হয় ‘ক্রসফায়ার’ মিশন। ডাকাত-সন্ত্রাসীদের ‘ক্রসফায়ার’ এর নামে একের পর এক মানুষকে হত্যা শুরু করে হাতিয়ে নেয় বিপুল অংকের টাকা। এক পর্যায়ে উপরি মহলে নানা তদবির করে ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবরে টেকনাফ থানায় ওসি হিসাবে যোগদান করেন এবং ‘ক্রসফায়ার’র নামে বেপরোয়া হয়ে উঠে ওসি প্রদীপ।
মহেশখালী থানায় থাকাকালিন সময়ে ওসি প্রদীপের হাতে ‘ক্রসফায়ার’-এ মারা যান উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের পানিরছড়া বাজার এলাকার মৃত মকবুল আহমদের ছেলে আব্দুল মালেক। প্রতিপক্ষের সাথে বিপুল পরিমাণ টাকায় অঘোষিত চুক্তি করে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট দিন দুপুরে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে শাপলাপুর দীনেশপুর ঢালায় পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে হত্যা করে। এসময় তার শরীরে ১টি ও ঘটনাস্থলে বিক্ষিপ্তাবে ৪টি এলজি, ৫ রাউন্ড কার্তুজ ও ৯ রাউন্ড খালি কার্তুজ উদ্ধার দেখায়। এমনটি অভিযোগ করছেন নিহত আব্দুল মালেকের বড় বোন হাজেরা খাতুন।
হাজেরা খাতুন কক্সবাজার ভয়েসকে অভিযোগ করেন, ‘আমরা তিন ভাই এক বোন। ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত প্রকৃতির লোক ছিল আব্দুল মালেক। জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে একটি মামলা ছাড়া আর কোন মামলা-মোকাদ্দেমা নেই। কিন্তু, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ প্রতিপক্ষ স্থানীয় আবুল কালাম, আব্দুল মান্নান, জাফর আলম, নুরুল কবির, সিরাজের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুষ নিয়ে আমাদের লবণ মাঠ প্রকাশ্যে দখল করে নেয় এবং আমার ভাইকে দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে ধরে নিয়ে শাপলাপুর দীনেশপুর ঢালায় নিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ নাটকের মাধ্যমে হত্যা করে। কিন্তু, ওসি প্রদীপের ভয়ে কোথাও কোন ধরণের বিচার চাওয়ার সুযোগ ছিল না। আজ এখন সুযোগ হয়েছে, তাই আমরা কক্সবাজার আদালতে সুষ্ঠু বিচার চেয়ে একটি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ওসি প্রদীপ মহেশখালী থানায় ওসি হিসাবে থাকাকালিন শুধু আব্দুল মালেক নয়, তার মতো অনেককেই ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে নিরহ মানুষকে হত্যা করেছে। এ কারণে প্রকৃত সন্ত্রাসী ও অপরাধিরা ওসির আশকারায় আরো বেশী বেপরোয়া হয়ে উঠেছি। সন্ত্রাসীদের জনপদ খ্যাত দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে ওসি প্রদীপ উল্লেখযোগ্য কোন সন্ত্রাসী, মাদক বা অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। পরে নানা তদবিরে বদলি হয়ে যায় সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে। টেকনাফ থানায় গিয়ে স্থানীয় সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন ওসি প্রদীপ।
২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় যোগদান করার পর স্থানীয় সাবেক সাংসদ বদি (ইয়াবার পৃষ্টপোষক হিসাবে তালিকাভূক্ত) ও তার পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। বিশেষ করে আব্দুর রহমান বদির ভাই মুজিবুর রহমান (বর্তমানে আত্মসমর্পনকারি গডফাদার হিসাবে কারাগারে) সাথে সব ধরণের অপরাধ কর্মকান্ড করে নিরহ মানুষদের ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে হত্যা করে। ভয়ংকর ইয়াবা গডফাদারদের (সাইফুল করিম ছাড়া) আত্মসমর্পণের সুযোগ করে দিয়ে একের পর এক ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে হত্যা করে ছোট-খাটো ইয়াবাকারবারিদের। তবে এদের বেশীরভাগ সাধারণ মানুষ। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ মাস টেকনাফ থানায় দায়িত্বপালন কালিন সময় পর্যন্ত ১৪৪টি ‘ক্রসফায়ার’র ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে ২০৪। এরমধ্যে শুধুমাত্র ওসি প্রদীপের মিশনের শিকার হয়েছে ১৬১জন।
টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের কচুবনিয়া গ্রামের ফিরোজা বেগম মুঠোফোনে কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘একটি মাত্র মারামারির মামলায় স্বামী আব্দুর রশীদকে ধরে নিয়ে যায় টেকনাফ থানা পুলিশ। পরে ‘ক্রসফায়ার’র ভয় দেখিয়ে খবর পাঠানো হয় ১৫ লাখ টাকা দিলে স্বামী আবদুর রশীদ বেঁচে যাবে। কিন্তু, অসহায় ফিরোজার পক্ষে ১৫ লাখ টাকা দেয়া সম্ভব ছিল না। পরে ওসি প্রদীপের কথা মতো টেকনাফ সদরের উপরে বাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী স্বজল ধর (ওসি প্রদীপের অঘোষিত এজেন্ট) কে ৪ লাখ টাকা জমা দেয়। কিন্তু, টাকা নেয়ার পরও তার বাড়িতে পুলিশ গিয়ে ভাংচুর করে এবং স্বামী আব্দুর রশীদকে ধরে এনে আরও টাকা দাবি করে। পরে দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় স্বামী আব্দুর রশীদকে ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে হত্যা করে। এরপর স্বর্ণ ব্যবসায়ী স্বজল ধরের কাছে টাকা ফেরত নিতে গেলে স্বর্ণকার স্বজল উল্টো পুলিশের ভয় দেখায়। এতে ফিরোজা নিরুপায় হয়ে পড়ে’। এ বিষয়ে ফোন বন্ধ থাকায় স্বজলের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
টেকনাফে ওসি প্রদীপের অঘোষিত এজেন্ট ছিল উপজেলার কিছু গ্রাম পুলিশ। সাবরাং ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ আলী আহমদ, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নুরুল আমিন সহ অনেকেই। এসব গ্রাম পুলিশরা সরাসরি ওসি প্রদীপের সাথে যোগাযোগ ছিল এবং অবৈধ টাকা কালেকশন করে ওসির দেখানো জায়গায় জমা করে আসতো।
টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের গুচ্ছ গ্রামের মৃত এজাহার মিয়ার ছেলে মকবুল আহমদ কক্সবাজার ভয়েসকে অভিযোগ করেন, ‘স্থানীয় জহির আহমদের সাথে আমার দীর্ঘদিন ধরে জমি বিরোধ ছিল। এই জমি বিরোধের জের ধরে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও এসআই সনজিত বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় ভাই হাসানকে। পরে স্থানীয় দফাদার আলী আহমদের মাধ্যমে খবর পাঠানো হয় ১০ লাখ টাকা দিলে হাসানকে ছেড়ে দেয়া হবে। না হয় ‘ক্রসফায়ার’ দেয়া হবে। কোন উপায়ন্তর না দেখে জমি বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা সহ দফাদার আলী আহমদকে সাথে নিয়ে ওসি প্রদীপের সাথে দেখা করতে গেলে এসআই সনজিত ও দফাদার আলী আহমদ ওসির সাথে কথা হয়েছে বলে ৫ লাখ বুঝে নেয়। পরে এক হাজার একশত পিস ইয়াবা দিয়ে ভাইকে কক্সবাজার আদালতে প্রেরণ করা হয়।’
জানতে চাইলে দফাদার আলী আহমদ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, হাসান একজন ইয়াবাকারবারি। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে আদালতে প্রেরণ করেছে। টাকা নেয়ার বিষয়টি সত্য নয়। কারণ আমার বাড়ি একই এলাকায় হওয়ায় সে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এব্যাপারে এসআই সনজিদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রতিনিধিদের অনেকে অভিযোগ করছেন, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২জন ইয়াবা কারবারিকে টাকার বিনিময়ে কৌশলে আত্মসমর্পন করিয়েছেন। তার পছন্দের শীর্ষ কারবারিদের আত্মসমপর্নের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে অন্যান্য ছোট ইয়াবাকারবারিদের অনেককে ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে হত্যা করে এলাকায় ভীতি সৃষ্টি করে।
প্রসঙ্গ, গত ৩১ জুলাই রাত ১০টার দিকে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো: রাশেদ খান। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ে পক্ষ থেকে একটি উচ্চ তদন্ত কমিটি গঠন করেন। একইভাবে ওসি প্রদীপ ও দায়িত্বরত পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯জনকে আসামী করে সিনহার বোন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি কক্সবাজার র্যাব ১৫ তদন্ত করছেন। উক্ত মামলায় ওসি প্রদীপ সহ ৩জনকে ৭দিন রিমান্ড ও অন্যান্য আসামীদের ২দিন করে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন। সর্বশেষ শুক্রবার ৭ আগস্ট ওসি প্রদীপ সহ ৭ আসামীকে সাময়িক বরখাস্ত করেন পুলিশ সদর দপ্তর। মামলাটি এখনো তদন্তাধিন রয়েছে।
ভয়েস/আআ