শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০১:৪৪ পূর্বাহ্ন
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর:
কোরআন-হাদিসের আলোকে অত্যন্ত মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস জিলহজ। এ মাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে রাসুল (সা.)-এর ঐতিহাসিক বিদায় হজের স্মৃতি। এ মাসেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অদম্য বাসনা নিয়ে সারা বিশ্বের সক্ষম ও সামর্থ্যবান মুসলমানরা পবিত্র হজ পালন করেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশে ওই গৃহের হজ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর যে এই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি সামান্যও মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আল ইমরান ৯৭)
মহান রবের নিকট একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণের উদ্দেশে সমবেত লাখো মুমিনের কণ্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় জন্মভূমি মক্কাতুল মোকাররমা। সবার পরনে একই ধরনের সাদা কাপড় (ইহরাম), সবার কণ্ঠে এক আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা এবং একই তরিকায় মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় তাকওয়া ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনুপম পরিবেশ। আধ্যাত্মিক চেতনায় দীপ্তিমান হয়ে উঠে মুমিনের আত্মা। তাওহিদি চেতনায় মহান প্রভুর সান্নিধ্যে বান্দার আত্মসমর্পণের কি অভূতপূর্ব মায়াবী দৃশ্য!
শুধু তাই নয়, এ মাসে রয়েছে ইসলামের শাশ্বত বিধান কোরবানি ও ঈদুল আজহা। যা মুসলিম উম্মাহর মাঝে তাকওয়ার অনুভূতি জাগ্রত করে, আর ইমানী স্পৃহাকে করে অধিকতর শানিত। সর্বোপরী কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের অন্যতম ঐতিহ্য। তথাপি ঈদুল আজহা আত্মত্যাগের আনন্দমুখর ও সম্প্রীতির বার্তাবহ একটি উপলক্ষ। তাই কোরবানি ও ঈদুল আজহার তাৎপর্য, শিক্ষা ও মাসয়ালা জেনে তদানুযায়ী আমল করা মুমিন-মুসলমানদের জন্য অবশ্য করণীয়।
কোরবানি আরবি শব্দ। এর অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন, ত্যাগ ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ এই তিন দিনের যে কোনো দিন আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবাই করাই কোরবানি। প্রতি বছর দশই জিলহজ ত্যাগ ও আনন্দের বার্তা নিয়ে মুসলমানদের দ্বারে হাজির হয় পবিত্র ঈদুল আজহা। এ দিন সকালে ঈদুল আজহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের পর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে সামর্থ্যবান মুসলমানরা শরিয়ত অনুমোদিত পশু কোরবানি করেন।
প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন, স্বাধীন ও মুকিম (মুসাফির নয় এমন ব্যক্তি) মুসলিম নর-নারীদের মধ্য থেকে যারা জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ পড় এবং কোরবানি করো। (সুরা কাউসার ২)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন কোরবানির চেয়ে উত্তম ও প্রিয় কোনো আমল নেই। কেয়ামত দিবসে কোরবানির জন্তুর শিং, পশম, খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কোরবানির জন্তুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই মহান আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। তাই তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো। (তিরমিজি)
সাহাবায়ে কেরাম নবী করিম (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন কোরবানি কি? উত্তরে তিনি বলেন, কোরবানি হলো তোমাদের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, এতে আমাদের জন্য কী বিনিময় রয়েছে? নবী করিম (সা.) বললেন, কোরবানির জন্তুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, তাহলে ভেড়ার হুকুম কী? তিনি বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বদলায়ও একটি করে সওয়াব রয়েছে। (ইবনে মাজাহ)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। (মুসনাদে আহমদ) তাই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানির মতো এই মহিমান্বিত ইবাদত থেকে বিরত থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বরং সর্বোচ্চ ইখলাস ও তাকওয়ার অনুভূতি নিয়ে কোরবানির মতো তাৎপর্যপূর্ণ আমলটি পালন করা সামর্থ্যবান মুসলমানদের ইমানি কর্তব্য।
ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর ইমানদীপ্ত সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহর জমিনে ইসলামের ঝাণ্ডা উঁচু করার জন্য নিজেদের জানমাল কোরবানিসহ সর্বোচ্চ ত্যাগের নজির পেশ করতে হবে। মহান আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে কঠিন থেকে কঠিনতম কষ্টও মেনে নিতে হবে। এটিই কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য ও মহান শিক্ষা। এই শিক্ষা ধারণ করতে হবে। আর পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি দিয়ে আত্মাকে করতে হবে পরিশুদ্ধ ও নির্মল। তখনই অন্তরে জাগ্রত হবে তাকওয়া তথা খোদাভীতি। সেই তাকওয়াই কোরবানি থেকে আল্লাহর একমাত্র চাওয়া। এ প্রসঙ্গে কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিকট কোরবানির গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না, বরং তার কাছে পৌঁছে একমাত্র তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ ৩৭)
ভয়েস/আআ