বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৩৯ পূর্বাহ্ন
আবদুল আজিজ:
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আগমনের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। এই দীর্ঘ তিন বছর ধরে বিপুল পরিমাণ এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সরকার নানা সুযোগ সুবিধা নিয়ে আসছে। মানবিক আশ্রয়ে থাকা এসব রোহিঙ্গারা যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে স্বদেশে ফিরতে পারে সেজন্য আন্তর্জাতিকভাবে কুটনৈতিক তৎপরতাসহ নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদা পুরণে সাহসিকতার নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার। এসব বিষয় নিয়ে কক্সবাজার ভয়েসের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার।
মাহবুব আলম তালুকদার বলেছেন,‘সরকার মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল রোহিঙ্গা আগমনের তিন বছর পূর্ন হয়েছে। এই তিন বছর ধরে রোহিঙ্গাদের কিভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে আসছে সরকার। যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা যায় সে ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘে দাবি জানিয়ে এসেছেন এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যা এখনো সরকার সব ধরণের কুটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে এখনো আমরা জরুরী অবস্থার মধ্যে আছি। স্বাভাবিক পরিস্থিতি এখনো শুরু করেনি। করোনা মোকাবেলায় আমরা সকলের সহযোগিতায় অনেকটা সফলতা অর্জন করেছি। প্রায় ১০লাখ রোহিঙ্গা জনবহুল এলাকায় এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৬জনে। এছাড়াও করোনার স্যাম্পল কালেকশনের পজিটিভ যে ফলাফল এর অনুপাত এখনো ৩ দশমিক ১। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে করোনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক কম। এরপরও ক্যাম্পহ গুলোতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে এ বছর কোন রোহিঙ্গাদের পূর্তি উপলক্ষে কোন ধরণের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাতে কোন রোহিঙ্গা জমায়েত হতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে’।
করোনাকালিন সময়েও সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক মহলের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন উল্লেখ করে মাহবুব আলম তালুকদার আরো বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী যে করোনাভাইরাসে পুরো পৃথিবীর মানুষ স্তব্ধ। এ কারণে বিশ্বনেতারা নিজ নিজ দেশ নিয়ে ব্যস্থ হয়ে পড়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মনোযোগ হারিয়েছে বলা যাবে না। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুটি একেবারে ভুলে গেছে তা নয়। সময় হলেই একটি রেজাল্ট আমরা অবশ্যই পাবো’।
মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সরকার কোনভাবে জোর করে কোন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত দিতে রাজি নয়। এটি নির্ভর করবে রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের স্বদিচ্ছার উপর। রোহিঙ্গারা যদি মনে করেন মিয়ানমারে এখনই নিরাপদ পরিবেশ তৈরী হয়েছে, তখন সরকার তাদের নিরাপদভাবে তাদের প্রত্যাবাসন করবে। এছাড়াও প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক আলোচনার বিষয় জড়িয়ে রয়েছে।’
মাহবুব আলম তালুকদার আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে বর্তমান সরকার দীর্ঘ তিন বছর ধরে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে সব ধরণের সুযোগ সুবিধা নিয়ে আসছে। যেমন একজন মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন সবকিছুর সুবিধা নিয়ে আসছে। স্যানিটেশন, খাদ্য,পণ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদা পুরনে রোহিঙ্গাদের জন্য সব কিছু করে যাচ্ছে।’
রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে সহযোগিতা আগের মতো এখনও অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধু আন্তর্জাতিক মহল নয়, দেশী-বিদেশী শতাধিক এনজিও রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে এখন কাজ করে যাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে কোন ধরণের সংকট নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো সেই আগের মতো স্বাভাবিকভাবে যাবতীয় কার্যক্রম চলছে।’
মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, এপিবিএন,আনসার সহ একাধিক এজেন্সী কাজ করছে। এতে করে পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে যেতে না পারে, রোহিঙ্গাদের অভ্যান্তরিণ কোন্দল সৃষ্টি হয়ে যাতে সহিংসতায় জড়িত হয়ে না পড়ে সব কিছু দেখভাল করছেন আইনশৃংখলা বাহিনী। এক কথায় খুব শান্তি শৃংখলার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গারা।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এনজিওদের কোন ধরণের ভুমিকা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এনজিওদের কাজ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সাপোর্টিং এজেন্সি। যেমন- বেশীর ভাগ এনজিও ইউএন অর্গানাইজেশনের পার্টনার এজেন্সি। সুতারাং এনজিওদের আলাদাভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। এনজিওদের কাজ হচ্ছে সরকারের সিদ্ধান্ত গুলো বাস্তবায়ন করা।’
এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আলম তালুকদার বলেন,‘আন্তর্জাতিক আদালতে গণত্যা ও নানা নির্যাতনের অভিযোগ এনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার রায়ে রোহিঙ্গাদের মনোবল আরো বৃদ্ধি করেছে। যার ফলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যাওয়ার ব্যাপারে আগে যে ভীতি কাজ করত সেটি অনেকাংশে কমে আসছে।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো একত্রে করার কোন চিন্তাভাবনা নেই উল্লেখ করে মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো এখন যে অবস্থায় রয়েছে আপাতত সেই অবস্থায় থাকবে। কারণ, আমরা তাদেরকে অস্থায়ীভাবে থাকার জায়গা দিয়েছি। এছাড়াও আইনশৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প, দাতাসংস্থার বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ক্যাম্প গুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে ১৯০০ বেটের আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত রয়েছে। কাজেই রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো আপাতত যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থায় থাকায় নিরাপদ।’
আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ে দেয়া প্রতিশ্রুতি গুলো বিচার বিশ্লেষণ করা কঠিন উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেভাবে সুবিধা পাচ্ছে, ঠিক ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা সমান সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছে। যেমন- করোনাকালিন সময়ে কক্সবাজারে যে দুইটি পিসিআর মেশিন আছে এবং ৪৮ ঘনটার মধ্যে রোগ নির্নয়ের রেজাল্ট পাচ্ছেন সব কিছু সম্ভব হয়েছে রোহিঙ্গাদের কারণে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডাব্লিউএফপি) মাধ্যমে স্থাপনে সম্ভব হয়েছে। এটি কিন্তু,কক্সবাজারবাসির জন্য বিশাল প্রাপ্তি। এছাড়াও রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশনের কাছে আমাদের সব সময় দাবি রয়েছে রোহিঙ্গারা যেসব সুবিধা পাবে, ঠিক স্থানীয় জনগোষ্টীরা যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এলপিজি সুবিধা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবাসহ বর্তমানে স্থানীয়রাও নানা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন।’
উল্লেখ্য, গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণসহ নানা বর্বর নির্যাতন করে বিতাড়িত করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অস্ত্রের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১১ লাখ ১৮ হাজারেরও বেশী রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ১০ হাজার একর বনভূমির উপর অস্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। দীর্ঘ তিন বছর ধরে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাদের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পাশাপাশি কাজ করছে দেশীও বিভিন্ন এনজিও। তবে যতদ্রুত সম্ভব এসব রোহিঙ্গাদের যে কোন উপায়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা জরুরী হয়ে পড়েছে, এমনটি প্রত্যাশা স্থানীয়দের।
ভয়েস/আআ