সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০২:১৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মানব পাচার: খালাস পেয়ে যায় সিংহভাগ মামলার আসামিরা

প্রতীকী ছবি

ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
মানব পাচারের ঘটনায় মামলা হয়। বিশেষ অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের। পুলিশি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে দেয়া হয় অভিযোগপত্র। এরপর শুরু হয় বিচারিক কার্যক্রম। কিন্তু বিচার শেষে খালাস পেয়ে যায় সিংহভাগ মামলার আসামিরা। গত দুই বছরে নিষ্পত্তি হওয়া ৮১ শতাংশেরও বেশি মানব পাচারের মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে। মাত্র ১৩টি মামলায় দণ্ডিত হয়েছে আসামিরা। অভিযোগপত্র হলেও মামলা খালাসের হার বেশি হওয়ার পেছনে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেয়ে ভুক্তভোগীর মামলা পরিচালনার অনীহাকে দায়ী করছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল অভিযোগপত্রে পার পেয়ে যাচ্ছে মানব পাচারকারীরা।

নিয়ম অনুযায়ী ভুক্তভোগীর অভিযোগ নথিভুক্ত করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আইনি প্রক্রিয়া। মামলার পর শুরু হয় তদন্ত। এ পর্যায়ে আসামি গ্রেফতার, অভিযোগের সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহসহ কয়েকটি ধাপে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এরপর তথ্যপ্রমাণে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করে বিচারিক কার্যক্রম শুরুর জন্য আদালতে দাখিল করা হয়। আর প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পেলে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিতে আবেদন করে পুলিশ। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থার পক্ষ থেকে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের ৭০টি মামলার মধ্যে ৮১ শতাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে। আর সাজা হয়েছে ১৮ শতাংশ মামলায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলোয় শক্তপোক্ত তথ্যপ্রমাণ ব্যতীত আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তদন্তকারী সংস্থার দুর্বল অভিযোগপত্রে পার পেয়ে যায় মানব পাচারকারীরা। আবার কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের ফলেও মামলার স্বাভাবিক তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি প্রসিকিউশন সার্ভিস পেতেও ভুক্তভোগীদের বেগ পেতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। এতে করে একদিকে যেমন মানব পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না, অন্যদিকে এ ধরনের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ভুক্তভোগীরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানব পাচার প্রতিরোধ সেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের সর্বমোট ৩১টি মামলা বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে ২৭টি মামলায় আসামিরা খালাস পায়। সাজা হয় চারটি মামলায়। সাজাপ্রাপ্ত মামলার আসামিদের মধ্যে সাতজনের যাবজ্জীবন এবং একজনের অন্যান্য মেয়াদে সাজা হয়। এর বিপরীতে বিচারিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে খালাস পায় ৫৪ জন। ওই বছরে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছিল ৫৬১টি। প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছিল ৪৮৯টি মামলার। আর চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয় ১৫১টি মামলার।

পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের সর্বমোট ৩৯টি মামলা বিচারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে ৩০টি মামলায়ই আসামি খালাস পায় ৬৮ জন। সাজা হয় নয়টি মামলায়। এসব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয় ২৫ জন। এর মধ্যে ১৭ জনের যাবজ্জীবন এবং বাকি আটজনের অন্যান্য মেয়াদে সাজা হয়। গত বছর মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মোট মামলা নথিভুক্ত হয়েছিল ৬৮৫টি। প্রাথমিক তদন্ত শেষে ৫৯৮টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয় ৯৭টি মামলায়।

মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর সাজা না হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি চলতি বছরে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০টি মামলা। এর মধ্যে আসামি খালাস পেয়েছে নয়টিতে। সাজা হয়েছে একটি মামলায়। মোট ১০টি মামলায় আসামি ছিল ৩১ জন। এর মধ্যে একজনের অন্যান্য মেয়াদে সাজা হয়েছে। বাকি ৩০ জন খালাস পেয়েছে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে সর্বমোট ২২৬টি। এর মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে ১০২টি মামলায়।

মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলা তদন্তে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, এ ধারার অধিকাংশ মামলাই হয়ে থাকে হিউম্যান স্মাগলিংয়ের। সাধারণত স্বেচ্ছায় বাড়তি আয়ের জন্য বিদেশ গিয়ে প্রতারিত হয়ে থাকে মানুষ। দেশে ফিরে মামলা করার পর শুরু হয় তদন্ত। তদন্তের একটা পর্যায়ে আসামিদের কাছ থেকে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার প্রস্তাব পেয়ে থাকে। এরপর তারা আর মামলা পরিচালনা করতে চায় না। ফলে অনেক মামলায় অভিযোগপত্র হলেও খালাস হয়ে যায়। তাছাড়া সময়মতো সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারার কারণেও বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়, যার একপর্যায়ে খালাস পেয়ে যায় আসামিরা।

মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলো মনিটরিং করে পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখা। সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে হালনাগাদ তথ্যসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়। প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের ১৪৫টি মামলা দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় বিচারাধীন রয়েছে ৪৭৮টি মামলা। এসব মামলার অধিকাংশই সময়মতো সাক্ষী হাজির করতে না পারায় বিলম্বিত হয়ে চলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলা খালাসের হার বেশি হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ মামলা গ্রহণ ও চার্জশিট তৈরির দুর্বলতা। এর পাশাপাশি ক্রিমিনাল জাস্টিসের ক্ষেত্রেও আমাদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। ভুক্তভোগীরা প্রসিকিউশন সার্ভিসও ঠিকমতো পায় না। যেমন ধরেন প্রসিকিউশন সার্ভিসের মধ্যেই তো আইনজীবী নিয়োগ থেকে শুরু করে ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিও রয়েছে। এখানে মনে রাখতে হবে মানব পাচারকারীরা কিন্তু খুবই শক্তিশালী। তারা নানাভাবে ভুক্তভোগীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এজন্য ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার আদালতেরও স্বল্পতা রয়েছে, যার ফলে দেখা যায় একের পর এক তারিখ পেছাতে থাকে। করে অনেক ক্ষেত্রে মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা প্রতিটি ডেটে আদালতে গিয়ে নতুন করে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। এজন্যও অনেক ভুক্তভোগী একটা সময় মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

দুর্বল অভিযোগপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, তদন্তই একটি মামলায় একমাত্র দিক নয়। যখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করেন, তখন তাকে অবশ্যই পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। তিনি নিখুঁত তদন্তের চেষ্টা করেন, যদিও এক্ষেত্রে উন্নতির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমরা তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে থাকি, যাতে তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিখুঁতভাবে তদন্ত শেষ করতে পারেন। সূত্র:বণিকবার্তা।

ভয়েস/জেইউ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION