শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:০২ পূর্বাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
ইন্টারনেট জগতের একেবারেই নবতম বিষয় হলো ফিফথ জেনারেশন সেলুলার নেটওয়ার্ক বা সংক্ষেপে ফাইভজি। এর আগের প্রতিটি ‘জি’র আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গতিশীলতা বেড়েছে মোবাইল ইন্টারনেটের। একই সঙ্গে বেড়েছে আরো জটিল ও ভারী ডাটার অ্যাপ্লিকেশন চালানোর সক্ষমতাও। মোবাইল ফোনকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেক্সট মেসেজিংয়ের উপযোগী করে তুলেছিল টুজি। সেখান থেকে বহুদূর এগিয়ে স্মার্টফোনে ভিডিও স্ট্রিমিং ও ভারী ডাটার অ্যাপ্লিকেশন চালানো সম্ভবপর করে তুলল ফোরজির আগমন। অন্যদিকে ফাইভজি এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি, রোবোটিকস ও ইন্টারনেট অব থিংসের (ইন্টারনেট সংযুক্ত সেন্সর ব্যবহার করে একাধিক যন্ত্রের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, যা সংক্ষেপে আইওটি নামে পরিচিত) মতো বিষয়গুলোকে (যা এতদিন ভাবীকালের প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল) বাস্তবে রূপ দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
ফাইভজি সক্ষমতাসংবলিত মোবাইল ফোন এরই মধ্যে বাজারে চলে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ফোন বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ। চলতি বছরের শেষ নাগাদ অ্যাপল নিজস্ব মডেলের ফাইভজি ফোন বিক্রি শুরু করলে এ সংখ্যা আরো বাড়বে। তবে এ মুহূর্তে গোটা বিশ্বে ব্যাপক হারে ফাইভজি নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে চাইলে প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ ও মোবাইল অবকাঠামোর উন্নয়ন। বড় মাত্রার এ রূপান্তরের সঙ্গে যেসব কোম্পানি একাত্ম হতে পারবে, সেগুলো ভবিষ্যতে অনেক লাভবান হবে। যদিও এক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যসব মুক্তবাজার প্রতিযোগিতার মতো খুব একটা সাধারণ নয়।
তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফাইভজির ইঁদুরদৌড় কোনো স্প্রিন্ট নয়, ব্যয়বহুল ম্যারাথন হয়ে উঠতে যাচ্ছে। চীনের মতো দেশও প্রায় এক দশক আগেই, যখন দেশটি মোটে থ্রিজি সক্ষমতা অর্জন করেছে, ঠিক সে সময়েই নিজের ফাইভজি কৌশল হাতে নিয়ে রেখেছে।
ফোরজির ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রযুক্তি আমদানি করার বদলে নিজস্ব প্রযুক্তি গড়ে তুলেছিল দেশটি। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি উন্নয়নের ব্যয়ের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল চীন। যদিও দেশটির ফোরজি নেটওয়ার্ক অনেক দিক থেকেই মার্কিন নেটওয়ার্কের মতো কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারেনি। বিপুল পরিমাণ ব্যয় করে হলেও অন্য যে কারো আগে ফাইভজি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে চীন। এক্ষেত্রে বিষয়টিকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে ফোরজির তিক্ত অভিজ্ঞতা।
বর্তমানে বিশ্বে ফাইভজি-সংক্রান্ত যত পেটেন্ট আছে, তার এক-তৃতীয়াংশই চীনের দখলে, পরিমাণের দিক থেকে যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। বর্তমানে ফাইভজি প্রযুক্তির পেছনে চীনের বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দ্বিগুণ। দেশটির এ বাবদ ব্যয়ের পরিমাণ নিকটতম তিন প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া ও জাপানের সম্মিলিত ব্যয়ের প্রায় সমান। ২০২৫ সালের মধ্যে ৮০ কোটি ফাইভজি সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। দেশটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, ওই সময়ে গোটা বিশ্বে ফাইভজির মোট সংযোগসংখ্যা দাঁড়াবে ১৮০ কোটিতে।
বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতে দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির এ একাধিপত্যের প্রতি চীনের চ্যালেঞ্জকে খুব একটা হালকাভাবে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ফাইভজির বিষয়ে মার্কিন প্রতিক্রিয়ার ব্যাপ্তি এখন বাণিজ্যকেন্দ্রিক শঙ্কা অতিক্রম করে আরো গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাপী চীনা ডিজাইনের ফাইভজি ইন্টারনেট ব্যবহারের শঙ্কার জায়গাটি শুধু ভোক্তার গোপনীয়তায়ই সীমাবদ্ধ নয়। কারণ নতুন এ প্রযুক্তি ভবিষ্যতের কারখানাগুলোর অটোমেশন, জ্বালানি গ্রিড নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় প্রতিরক্ষার মতো বিষয়গুলোয় মুখ্য ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এসব বিষয়ের সংবেদনশীলতাই বর্তমানে ফাইভজির ইঁদুরদৌড়কে ভূরাজনৈতিক বিষয় করে তুলেছে, যার সূচনা এ দৌড়ে চীন এগিয়ে যাওয়ার পর থেকে। এ ভূরাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, তাইওয়ান ও ভারতের মতো দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে নিজস্ব ডাটা নেটওয়ার্কে চীনের ফাইভজি চ্যাম্পিয়ন হুয়াওয়ের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করেছে।
হুয়াওয়ের সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে যুক্তরাষ্ট্র এখন অস্ত্র বানিয়েছে কম্পিউটার চিপকে। চীনের গবেষণা ও উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও এখনো যাবতীয় চিপ ডিজাইনের (এর মধ্যে ফাইভজি নেটওয়ার্কের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান তৃতীয় প্রজন্মের সেমিকন্ডাক্টরও রয়েছে) দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে। নিজ ভূখণ্ডে ডিজাইনকৃত কোনো চিপ হুয়াওয়ের কাছে সরবরাহের ওপর এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে যদি কোনো মার্কিন চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে চিপ সরবরাহ করতে চায়, সেক্ষেত্রে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটিকে সংশ্লিষ্ট মার্কিন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা কমাতে চীন এখন স্থানীয়ভাবেই সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে। বেইজিংয়ের উৎসাহে হুয়াওয়েও নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন কার্যক্রমের একাংশ স্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনে (এসএমআইসি) স্থানান্তর করেছে। এসএমআইসি বর্তমানে চীনের বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী হিসেবে স্বীকৃত।
তাই বলে মার্কিনদের চাপ হুয়াওয়েকে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে, এমন কিছু মনে করারও কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র চিপকে অস্ত্র বানালেও পণ্যের মানের লড়াইয়ে হুয়াওয়ে এখনো এগিয়ে। বিশ্বব্যাপী ফাইভজি নেটওয়ার্ক পরিচালনার মান নির্ধারণে এরই মধ্যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফাইভজি নেটওয়ার্কের মান নির্ধারণের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম থার্ড জেনারেশন পার্টনার প্রজেক্টের (থ্রিজিপিপি) সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পেটেন্টও হুয়াওয়ের সবচেয়ে বেশি। মানের দিক থেকে হুয়াওয়ের এ অগ্রসরতা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কাটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানটির উচ্চাভিলাষের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু মানের কারণেই স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে ফাইভজি অপারেটিং স্পেক তৈরি নিয়ে হুয়াওয়ের সঙ্গে কাজ করতে দিতে বাধ্য হচ্ছে ওয়াশিংটন। বাস্তবতা হলো যেসব দেশ স্থানীয় পর্যায়ে হুয়াওয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, ভবিষ্যতে সেসব দেশকেও প্রতিষ্ঠানটিকে রয়্যালটি বাবদ অর্থ পরিশোধ করতে হতে পারে।
লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে জাতীয় নিরাপত্তার বদলে অর্থনৈতিক স্বার্থ গুরুত্ব পায় বেশি। এসব দেশ হুয়াওয়ের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করে দেয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। এসব দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি এরই মধ্যে চীনের সঙ্গে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। একই সঙ্গে টেলিকম খাতে চীনা সরবরাহকারীদের ওপরও এসব দেশের নির্ভরতা অনেক বেশি। এছাড়া সুলভ ও টেকসই সেবার দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোথাও হুয়াওয়ের বিকল্প খুব কমই রয়েছে।
বর্তমানে সংবেদনশীল শিল্পগুলোর অনশোরিং (সংশ্লিষ্ট কোম্পানির উৎপাদন কার্যক্রম নিজ দেশের সীমানাতেই সীমাবদ্ধ রাখা) নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। তার পরও বিশ্বায়নই এখনো প্রযুক্তি জগতের চালিকাশক্তি। কোনো একক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অথবা চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল ও সম্পদশালী কোনো একক দেশের পক্ষে ফাইভজি প্রযুক্তির সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব নয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় স্যামসাং ফাইভজি প্রযুক্তি নিয়ে অনেকদূর এগিয়েছে। এছাড়া নিজ দেশের সীমানায়ও শক্ত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে পারে হুয়াওয়ে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে জেডটিই ও স্বল্পমূল্যে হ্যান্ডসেট সরবরাহকারী চীনা প্রতিষ্ঠান শাওমি। এছাড়া তাইওয়ানি চিপ নির্মাতা মিডিয়া টেকও ফাইভজি যুদ্ধে বেশ সম্ভাবনাময় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া অ্যাপল, কোয়ালকমের মতো মার্কিন টেক টাইটানরাও শেষ হওয়ার আগেই এ লড়াইয়ের গতিপথ বদলে দিতে সক্ষম।
স্বল্পমেয়াদি ভূমিকা রাখলেও রাজনীতি এককভাবে ফাইভজির উন্নয়নকে মাঝপথেই থামিয়ে দিতে পারবে না। বর্তমানে চীন সরকারের দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর নিবদ্ধ। তবে ওই নির্বাচনের ফল যা-ই হোক না কেন, রাজনীতিকে নিজ প্রত্যাশা পূরণের পথে বাধা হয়ে উঠতে দেবে না চীন। কারণ দেশটি এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত অনেক বিনিয়োগ করে ফেলেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল বা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক চিত্রপট যেমনই হোক না কেন, ফাইভজির অগ্রগতি অবশ্যম্ভাবী।
রবার্ট হর্টন: (লাইভ ওয়্যার মার্কেটস থেকে অনূদিত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত। লেখক রিচার্ড হর্টন বিনিয়োগ উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ল্যাজার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ডেভেলপিং মার্কেটস ইকুইটি বিভাগের পরিচালক ও রিসার্চ অ্যানালিস্ট) সূত্র:বণিকবার্তা
ভয়েস/জেইউ।