সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০২:২৩ পূর্বাহ্ন
ইয়াবা নিয়ন্ত্রণের বড় বাধা জামি
দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে একসময় ফেনসিডিল আসক্তি ছিল বড় সমস্যা। কিন্তু গত এক দশকে সেই স্থানটি দখল করে নিয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা উত্তেজক বড়ি ইয়াবা। প্রতি বছরই বিভিন্ন পেশাজীবী এবং নানা বয়সী মানুষের মধ্যে এ বড়ির আসক্তি ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহভাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নিয়েছে একাধিক কঠোর পদক্ষেপ।
ইয়াবার উৎপাদন, পরিবহন, বিপণনের জন্য সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ২০১৮ সালে পাস করা হয় নতুন আইন। ওই বছর থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে মারা যায় কয়েকশ ‘কারবারি’। গ্রেপ্তার করা হয় রেকর্ড কয়েক হাজার। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া কারবারিদের মধ্যে বড় একটা অংশই জামিনে মুক্ত হয়ে ফের একই কারবারে জড়িয়েছে। এ কারণেই দিন দিন ইয়াবার কারবার বেড়েছে, সহজলভ্য হয়েছে নেশার এ বড়ি। ইয়াবার এমন সহজলভ্যতার কারণে সহজেই আসক্ত হচ্ছে যুবসমাজ। মেধাবী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ছাত্ররাজনীতির উদীয়মান নেতারা এর কবলে পড়ছেন সহজেই। অভিভাবকদের পাশাপাশি উদ্বিগ্ন র্যাব-পুলিশের কর্তারাও।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী, দেশের আদালতগুলোয় ২০১৮ সালে ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো মাদক মামলা বিচারাধীন ছিল। গত দুই বছরে আরও ৪০ হাজার বেড়ে তা এখন হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যাও ৩০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগ মামলার আসামিরাই জামিনে মুক্ত হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ সালের ১ মে থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ছয় মাসে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম মহানগরসহ ১৩টি আদালতে ৩১২টি মাদকের মামলার রায়ের কথা। ওইসব মামলায় সাজা পাওয়া ৬৪৯ আসামির মধ্যে ৩৮২ জনই রায় ঘোষণার আগে জামিনে গিয়ে পলাতক হয়ে যায়। জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে প্রথম দুই-তিন মাস আদালতে হাজিরা দেয় মাদক মামলার আসামিরা। কিন্তু মামলার রায় ঘোষণার সময় এগিয়ে এলেই উধাও হয়ে যায় তারা। রায়ে আদালত সাজা দিলেও পুলিশ আর তাদের খুঁজে পায় না। কিছুদিন গেলে এদের অনেকেই ফের মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ে।
এমন ঘটনা ঘটে দেশের প্রায় সব এলাকায়ই। গত বছর ২৫ ডিসেম্বর ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসভার ছোলনা গ্রামের বাসিন্দা কাইয়ুম মোল্যা নামে এক মাদক কারবারিকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে এর আগেও ১৫টি মাদকের মামলা ছিল। অল্প সময়ে আইনের ফাঁক গলিয়ে ওই ১৫টি মামলায় জামিন নিয়ে ফের একই ব্যবসা শুরু করে সে। বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড নিহত হওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে আগেও আটটি মামলা ছিল। এর মধ্যে ছিল মাদকের একাধিক মামলা। ২০১৭ সালের এক মামলার চার্জশিটে মাদকের মূল্য ধরা হয় প্রায় ১২ লাখ টাকা। নয়নের বিরুদ্ধে মামলাটি ছিল সবচেয়ে গুরুতর। তবে এ মামলাটিতেও মাত্র এক মাসের মধ্যেই জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসে নয়ন। চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে মাদক কারবারি নয়ন হয়ে ওঠে পেশাদার খুনি।
উল্লিখিত এসবের জন্য দায়ী করা হচ্ছে দুর্বল মামলাকে। মামলায় ফাঁকফোকর না থাকলে অবশ্যই এ নৃসংশ হত্যার ঘটনা ঘটত না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
মাদক মামলার তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ তদন্তের জটিলতা এড়াতে মাদক কারবারি হিসেবে মামলা না দেওয়ায় সহজেই জামিনে বেরিয়ে ফের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে আসামিরা। ইয়াবা বিদেশ থেকে চোরাচালানি হিসেবে আনা হলেও মামলা হচ্ছে ‘ব্যবসায়ী’ হিসেবে। একইভাবে প্রতিবেশী দেশ থেকে ফেনসিডিল ও গাঁজা চোরাই পথ দিয়ে পাচার করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। চোরাইপথে আমদানি হওয়া মাদকের ওইসব মামলাও হচ্ছে শুধু মাদক কারবারি হিসেবে।
যদিও ইয়াবার উৎপাদন, পরিবহন, বিপণনের জন্য সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ২০১৮ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিল ২০১৮’ পাস হয়। গত বছর ২৭ ডিসেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর করা হয়। তবে ওই আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মাদকদ্রব্যের সব অপরাধ বিচার করার কথা বলা হলেও দীর্ঘদিন বিষয়টি ঝুলে ছিল। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে ১৯ তারিখে মাদক মামলার বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান বাদ দিতে বিল পাস করেছে জাতীয় সংসদ।
আইনের এমন ফাঁকফোকরের পাশাপাশি আছে রাজনৈতিক প্রভাবও। যেমন গত ২৫ নভেম্বর রাতে ঢাকার আশুলিয়া থানার জিরানী টেঙ্গুরী বাজার জাফর মার্কেটে শীর্ষ মাদক কারবারি হালিমার আস্তানা থেকে ৫ হাজার ৫৭০ পিস ইয়াবাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেন র্যাব-১-এর সদস্যরা। ওই মামলায় মো. আজিমউদ্দিন ও মো. সাদেক নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলে মাদকসম্রাজ্ঞী হালিমাসহ তার সহযোগীরা আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। শুধু রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে হালিমা ও তার মাদক কারবারে সহযোগীরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ ও র্যাব তাদের গ্রেপ্তার করতে পারছে না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
স্থানীয় এসব কারবারির যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না তেমনি মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারে সরাসরি যারা জড়িত তারাও রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত ১ আগস্ট রাতে টেকনাফের শাপলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর কক্সবাজারে পুলিশে ব্যাপক রদবদলের পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে ইয়াবা কারবারিরা গা-ঢাকা দেয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তারা ফের সক্রিয় হয়ে উঠে। প্রায় অর্ধশত স্পট দিয়ে দেদার ইয়াবা পাচার করে আসছে ওই পাচারকারীরা। অভিযোগ উঠেছে, এ নতুন পদ্ধতিতে ইয়াবা নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে হাকিম ডাকাত নামে এক রোহিঙ্গা সদস্য। ইয়াবা পাচারে এ ধরনের ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক হলো বহুল আলোচিত হাকিম ডাকাত। আবদুল হাকিম নামে রোহিঙ্গা নাগরিক প্রায় অর্ধশত নিয়ন্ত্রক দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে এখন ইয়াবার বড় বড় চালান প্রবেশ করছে অনায়াসেই। আর এসব ইয়াবা সারা দেশে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। ধরা পড়ছে মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ ইয়াবার চালান।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ইয়াবার বিরুদ্ধে অভিযান থেমে যায়নি। বরং র্যাব অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ ইয়াবাসহ মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ছয় মাসে র্যাব অভিযান চালিয়ে বিপুলসংখ্যক ইয়াবা উদ্ধার করেছে। এসব ঘটনায় মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। দুর্বল মামলা ও সহজ জামিনের বিষয়ে তিনি বলেন, জামিনের বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। আর থানায় সংশ্লিষ্ট আইনেই মামলা নিচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন জানান, আইনের ফাঁকফোকর গলে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজার মামলাগুলো হালকাভাবে নেওয়ায় মাদক কারবারিরা সহজেই জামিনে বেরিয়ে আসছে। মামলায় মাদক পাচারের আইনে হলে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলে এ পেশায় যুক্ত হতে পারত কম।
ভয়েস/আআ