শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৭:৫১ অপরাহ্ন
আবদুল আজিজ:
মোস্তাক আহমদ ওরফে ইয়াবা মোস্তাক। কক্সবাজার জেলার শীর্ষ ইয়াবাকারবারির তালিকায় রয়েছে তার নাম। ইয়াবা পাচার করে দু’হাতে কামিয়েছে কোটি কোটি টাকা। বাড়ি, গাড়ি, জমি, জমা, ব্যাংক ব্যালেন্স সহ গড়ে তুলেছে এক বিশাল সাম্রাজ্য রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক। তার বিস্তৃত নেটওয়ার্কে পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি টাকার ইয়াবা। একারণে আইনশৃংখলা বাহিনী অনেকবার তার বিস্তৃত নেটওয়ার্কে হানা দিলেও বার বার ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছে ইয়াবা মোস্তাক। গত বুধবার (১০ মার্চ) র্যাবের এমনই এক অভিযানে ফসকে যায় ইয়াবা মোস্তাক।
র্যাব সূত্র জানিয়েছেন, বুধবার রাত ৮টার দিকে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের তালিকায় শীর্ষে থাকা ইয়াবা কারবারি মোস্তাক আহমদ ওরফে ইয়াবা মোস্তাকের একটি ইয়াবার চালান পাচার হচ্ছে এমন গোপন সংবাদে অভিযানে নামে র্যাব-১৫ একটিদল। এসময় বরাবরের মতো অভিযানের খবরে পালিয়ে যান মোস্তাক। অভিযানে মোস্তাকের তিন সহযোগি রামু উপজেলার খুনিয়াপালং এলাকার মৃত আজিম উদ্দিনের ছেলে জাফর আলম (৩০), মীর আহমদের ছেলে মোঃ জয়নাল (৩৮) ও মৃত সিরাজ মিয়ার ছেলে রহিম উল্লাহ (২৬) কে ২০ হাজার পিস ইয়াবা সহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গ্রেপ্তারকৃতদের স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে র্যাব-১৫ কক্সবাজারের সহকারি পরিচালক মিডিয়া আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ শেখ সাদী কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘উদ্ধার হওয়া ২০ হাজার পিস ইয়াবার প্রকৃত মালিক মোস্তাক আহমদ ওরফে ইয়াবা মোস্তাক। গ্রেপ্তারকৃত তিন সহযোগিকে নিয়ে ইয়াবা বিক্রি করার জন্য ওইদিন স্থানীয় মরিচ্যাবাজার এলাকায় অবস্থান করে। কিন্তু, র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যান মোস্তাক।
র্যাবের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ শেখ সাদী আরও জানান, মোস্তাক আহমদ বড় মাপের একজন ইয়াবা কারবারি। র্যাব সদস্যরা দীর্ঘদিন তাকে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ অদৃশ্য কারণে সে বার বার ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।’
উখিয়ার থানার ওসি (তদন্ত) মো: সালাহ উদ্দিন কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারকৃত তিন ইয়াবাকারবারি সহ মোস্তাকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। উখিয়া ও কক্সবাজার সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোস্তাক আহমদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাকে ধরার জন্য পুলিশ তৎপর রয়েছে। অবশ্য, তাকে একদিন পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে।’
রামু থানার ওসি কেএম আজমীরুজ্জামান কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘মোস্তাক আহমদ একজন বড় মাপের ইয়াবাকারবারি। কিছু জনপ্রতিনিধির আড়ালে সে দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবার বড় চালান পাচার করে আসছে। কিন্তু, হাতেনাতে না পাওয়াতে তাকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে যেসব ইয়াবার মামলা রয়েছে, সবকটিতে জামিনে রয়েছে। এমনকি আদালতের নির্দেশে তার বাড়ির ক্রোক করা মালামালও পুনরায় আদালতের মাধ্যমে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। এরপরও রামু থানা পুলিশ তাকে কড়া নজরধারিতে রেখেছেন। অবশ্য, কোন না কোন একদিন সে ধরা পড়বে। কারণ সে একজন মুখোশধারী ইয়াবাকারবারি।’
কে এই ইয়াবা মোস্তাক: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা চোরাকারবারি মোস্তাক আহমদ ওরফে ইয়াবা মোস্তাকের বাড়ি রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের পূর্ব গোয়ালিয়াপালং এলাকার আশরাফ মিয়ার ছেলে। তার বাবা আশরাফ মিয়া পেশায় কাঠুরিয়া। জন্মের পর থেকে খেয়ে না খেয়ে জীবন গেছে তাদের। কিন্তু এখন ইয়াবার কল্যাণে কাঠুরিয়া বাবার সংসারকে কোটিপতির কাতারে নিয়ে গেছেন মোস্তাক। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দরিদ্র বাবার টাকায় অল্প পড়াশোনা করে আনসার বাহিনীতে যোগ দেন মোস্তাক। ছোটবেলা থেকেই লোভী প্রকৃতির ছিলেন তিনি। এ কারণেই অল্প বেতনের আনসার সদস্যের চাকরি ছেড়ে দেন সে। এরপর তার বড় ভাই মনসুরের হাত ধরে মিয়ানমারের চোরাই পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন। মরিচ্যা বাজার এক সময় ছিলো চোরাইপণ্য পাচারের ঘাটি। শুরু থেকেই মিয়ানমার সীমান্ত থেকে চোরাই পথে কাপড়, আচার, বিয়ার, মদসহ নানা পণ্য নিয়ে আসে। সেখানেও তার ভাগ্য খুলেনি। পরে শুরু করে মুরগীর ব্যবসা। এই মুরগী ব্যবসার আড়ালে দেশের বিভিন্ন স্থানে জড়িয়ে পড়ে ইয়াবা পাচারে। এক সময়ের মুরগীর বিক্রেতা মোস্তাক এখন কোটি কোটি টাকার মালিক, গড়ে তুলেছে বিত্তবৈভব, গাড়ি, বাড়ি, ফিশিং বোটসহ আরো অঢেল সম্পদ, কোটি টাকা খরচ করে হয়েছেন জনপ্রতিনিধিও।
যেভাবে ভাগিয়ে নেন জনপ্রতিনিধির পদ: বিশাল সা¤্রাজ্যের অধিকারি ইয়াবা মোস্তাকের পেছনে দৌড়ে স্থানীয় ও জেলার বাঘাবাঘা জনপ্রতিনিধিরা। গত ইউপি নির্বাচনে তার ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড থেকে ইউপি সদস্যপদে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে তৎকালিন প্রশাসনের কর্তাবাবু থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের কিছু রাজনৈতিক নেতাদের হাত করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভাগিয়ে নেন ইউপি সদস্যের পদটি। এতেও তার শেষ আশ্রয় হয়নি। আইনশৃংখলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে সপরিবারে পালিয়ে যান রাজধানী ঢাকায়। এসময় ক্রসফায়ারের ভয়ে ঢাকাতে ভাড়া বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের রেখে ইয়াবাপাচারের একটি মামলায় আদালতে জামিন হতে গিয়ে কৌশলে নিজ উদ্যোগে কারাগারে ঢুকে পড়ে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর গত বছরের ৩১জুলাই টেকনাফে পুলিশের তল্লাশী চৌকিতে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মো: রাশেদ হত্যাকান্ডের পর পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর অনেকটা নিস্ক্রিয়তার সুযোগে কারাগার থেকে বের হয়ে এলাকায় ফিরে আসে। পরে পুনরায় বীরদর্পে চালিয় যান ইয়াবাকারবার।
মোস্তাকের বিরুদ্ধে যত মামলা: শীর্ষ ইয়াবাকারবারি মোস্তাক আহমদের বিরুদ্ধে রয়েছে দেড় ডজনেরও বেশী মামলা। তবে সব মামলায় জামিনে থেকে প্রকাশ্যে ঘুরছে এলাকায়। অংশ নিচ্ছে সভা-সমাবেশ ও ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মকান্ডে। তবে কিছুদিন ইয়াবাকার বন্ধ থাকলেও আবারও ফিরেছে কারবারে। স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠে ইয়াবাকারবারে। এখন প্রতি সপ্তাহে ইয়াবার চালান ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয়ভাবে মোস্তাকের জনপ্রিয়তা:মোস্তাকের নির্বাচনী এলাকা রামুর খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডে তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। কয়েক বছর আগে তার বাড়ির পাশে মরিচ্যা গোয়ালিয়া খালের ধ্বসে পড়া ব্রীজ তার অর্থায়নে মানুষের চলাচলের সংস্কার করে স্থানীয়দের নজর কাড়ে। শুধু ব্রীজ সংস্কার নয়, ধুরন্ধর এই ইয়াবা কারবারী এলাকার জনগণের মন জয় করার নানা কৌশল রপ্ত করেছে। অবশ্য টাকার কেরামতিতেই সব সম্ভব হয়েছে। গ্রামের প্রতিটি দরিদ্র পরিবারের যুবক-যুবতীর বিয়ের দায়িত্বও নেন তিনি। তাদের বিয়েতে যত টাকা খরচ হয় সবই বহন করে মোস্তাক। অনেককে নিয়ে টাকায় বিয়ে সাদি দিয়েছে। এ কারণে তার প্রতি সাধারণ মানুষের দরদ বেশি। আর সেটি কাজে লাগিয়েই তিনি এখন খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির তকমা লাগিয়ে নিষিদ্ধ ব্যবসার গুরুর আসনে।
স্থানীয় একাধিক সুত্র মতে, ‘দীর্ঘ সময় ধরে তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে স্থলপথে ইয়াবা পাচার করে আসলেও গত কয়েক বছর ধরে সাগরপথকে নিরাপদ মনে করছেন মোস্তাক। ইয়াবা বহনের জন্য মোস্তাকের রয়েছে একাধিক ফিশিং বোট। এসব ফিশিং বোট দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বহন করে ইনানী সমুদ্র এলাকা রেজু খালের মোহনায় নিয়ে আসে। সেখানে ইয়াবাগুলো খালাস হয়ে তার বোনের জামাই সোনারপাড়া ঘাটঘর এলাকার ছুরুত আলমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হচ্ছে।
এব্যাপারে ইয়াবা মোস্তাকের মোবাইল ফোনে বার বার যোগাযোগ করে একাধিক সীম পাল্টানোর কারণে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
ভয়েস/আআ