সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

প্রতারণা আর প্রতারকের নিবিড় চাষের কালে

রুমিন ফারহানা:
বাংলাদেশে বসবাস করে ‘মেইড ইন জিঞ্জিরা’ শোনেননি, এমন মানুষ বিরল। ছোটবেলা থেকে কোনো কিছু কেনার পর নকল মনে হলেই বুঝে যেতাম যতই রংচঙে মোড়ক হোক, জিনিসটি আসলে ‘মেইড ইন জিঞ্জিরা’। নকলকে অবিকল আসলের মতো ফুটিয়ে তুলতে জিঞ্জিরার কোনো বিকল্প নেই। তাদের এই দক্ষতা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে। এই নকলের প্রসার কেবল পণ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে এক রকম ছিল। কিন্তু না, এখন নকল-পণ্য থেকে নকল-পেশাজীবী দুটোরই রমরমা চলছে দেশে। একবার ঢাকা জজ কোর্টে দেখি বিরাট বিলবোর্ড জুড়ে বেশকিছু মানুষের লাজুক মুখের ছবি। কালো কোট-টাই পরা মানুষগুলোর গলায় ঝুলছে ‘আমি টাউট’ লেখা কাগজ। খবর নিয়ে জানলাম, আইন বিষয়ে কোনো পড়াশোনা না থাকলেও আইনজীবী পরিচয় দিয়ে মক্কেল ধরছিলেন তারা। একইভাবে প্রায়ই পত্রিকায় দেখি ভুয়া ডাক্তারের খবর।

ডাক্তার কিংবা উকিল সাজার সহজ যুক্তি আছে। এই দুই পেশায় মোটামুটি জমিয়ে বসতে পারলে আয়-রোজগার মন্দ নয়। কয়েক বছর ওষুধের দোকানে কাজ করলেই বেশ কিছু উপসর্গের ওষুধ সম্পর্কে ভালো ধারণা জন্মে যায়। এরপর স্নাতক বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাইনবোর্ড দিয়ে দোকান ভাড়া নিলেই হলো। কিছু রোগী সন্তুষ্ট করতে পারলে আর ফি একটু কম রাখলে সারা জীবনই মোটামুটি করে খাওয়া সম্ভব। একই কথা উকিলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আদালতে জামিন আবেদন শুনানিতে খুব বেশি আইনি জটিল তর্কের প্রয়োজন পড়ে না। মোটাদাগে কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করতে জানলেই কাজ হয়ে যায়। দু’টি পেশাই স্বাধীন, তাই আয় রোজগার শূন্য থেকে অসীম পর্যন্ত যে কোনো কিছু হতে পারে। সঙ্গে দুই নম্বরি কিছু কায়দা জানা থাকলে তো কথাই নেই।

কিছুদিন আগে মিডিয়ায় আসা একটা নাম খুব আলোচিত হলো। আব্দুল কাদের। পড়েছেন মাত্র দশম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু তিনি নিজেকে একজন অতিরিক্ত সচিব বলে পরিচয় দিতেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইডি কার্ড বানিয়ে, ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে, গাড়িতে স্টিকার ও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগিয়ে নিজেকে তিনি অতিরিক্ত সচিব হিসেবে জাহির করেন। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ এনে দেওয়া, বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ পাইয়ে দেওয়া, চাকরি পাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি বলে কমিশন নেওয়াই ছিল তার মূল পেশা। নিজ মালিকানাধীন হাউজিং কোম্পানির নামে জমির প্রতারণামূলক বায়না করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে শুধু প্রাথমিকভাবে দেখা করার জন্যই ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি ফরম ফিলাপ করতে হতো! আব্দুল কাদেরের সঙ্গে নাম জড়িত হয়েছে বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের। সেই ঘটনার পর পর তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে জনাব মুসার ভাষ্য মতে তিনিও কাদেরকে সত্যিকারের অতিরিক্ত সচিব মনে করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন তিনি অনেক ক্ষমতাবান মানুষ।

প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে রাজধানীর গুলশানের জব্বার টাওয়ারে ছয় হাজার স্কয়ার ফিটের একটি কার্যালয় রয়েছে তার। এছাড়া কারওয়ান বাজারে রয়েছে আরেকটি কার্যালয়। তিনি মিরপুর ৬ নম্বর সেক্টরে বসবাস করেন। গুলশান ও মিরপুরে তার একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে। গাজীপুরে নয় তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি ও গাজীপুরের পুবাইলে একটি বাগানবাড়ি রয়েছে তার। এই সবই তিনি করেছেন তার আমলা পরিচয় ব্যবহার করে। অর্থাৎ কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি তৈরি হয়েছে কেবলমাত্র আমলা পরিচয় দিয়ে। এই ঘটনা প্রথম নয়, অনেক সময়ই চোখে পড়েছে এ ধরনের খবর। এই কলাম লেখার সময় গুগল করে দেখলাম দেশের নানা প্রান্তে উপ-সচিব, যুগ্মন্ডসচিব, অতিরিক্ত সচিব এমনকি সচিব পরিচয়ে বহু প্রতারক আটক হয়েছেন। এদের সবাই আব্দুল কাদেরের মতোই নিজের প্রশাসনিক ক্ষমতা/প্রভাব ব্যবহার করে মানুষকে অবৈধভাবে নানা স্বার্থ উদ্ধার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

গণমাধ্যম লক্ষ করলে দেখা যায়, আরেকটি পেশার ক্ষেত্রেও প্রচুর ভুয়া পেশাজীবী পাওয়া যায়। এটা হচ্ছে পুলিশ। ভুয়া সাধারণ পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের খবর খুব নিয়মিত পাওয়া যায় মিডিয়ায়। এর মধ্যে বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি’র ভুয়া সদস্য সাজা। উকিল বা ডাক্তারের মতো আমলা/পুলিশ পেশাটি ব্যবসা নয়। আর সে কারণেই বেতন-ভাতার বাইরে তাত্ত্বিকভাবে তাদের কোনো রোজগার থাকার কারণ নেই। আর ভুয়া আমলা বা পুলিশের বেতন পাওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। তাহলে আব্দুল কাদেরের মতো বহু মানুষ কেন ভুয়া আমলা সাজতে যান? কেন অনেক মানুষ ভুয়া পুলিশ সদস্য/কর্মকর্তা সাজেন। এমন তো না আমলা/পুলিশ সাজলে ঘরে বেতনের টাকা পৌঁছে যাবে! নানা বিভাগের ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা সাজার প্রতিটি রিপোর্টে দেখা যাবে তারা সেটা করছেন মানুষকে নানা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে দেবেন বলে। ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদেরের ক্ষেত্রে আমরা মাত্রই দেখলাম সেটা। অন্যদিকে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয়ের ক্ষেত্রে নানা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা এনে দেওয়ার বিষয় যেমন আছে, তেমনি উচ্চপদস্থ তো বটেই, একেবারে সাধারণ পুলিশ সদস্য হওয়ার আরেকটি ‘উপযোগ আছে’, মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে কিংবা নিপীড়নের ভয় দেখিয়ে টাকা উপার্জন করা।

প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব প্রতারকের প্রতারণা ব্যবসার আসল ভিত্তি কী? কেন একজন মানুষ সরকারি আমলা কিংবা পুলিশ অফিসার পরিচয় পাওয়ার পর কারও হাতে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে দেন? বাজারে এইসব প্রতারকের জোগান থাকার মানে হচ্ছে, এর একটা চাহিদাও আছে। কোনো মানুষ ব্যাংক লোন পাওয়ার জন্য বা সরকারি কোনো ঠিকাদারি পাওয়ার জন্য কিংবা কোনো নিয়োগের জন্য কোনো প্রতারকের হাতে টাকা তুলে দেন। কারণ তারা জানেন এমন পদে চাকরিরতরা নানাভাবে রাষ্ট্রীয় আইন এবং বিধিবিধানকে পাশ কাটিয়ে মানুষকে অন্যায় সুবিধা এনে দিতে পারেন। বহু ক্ষেত্রেই মানুষের জমি দখল কিংবা টাকা আত্মসাৎ করার ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পান না। কারণ তারা জানেন এই দেশে তেমন ক্ষমতাবানদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না ‘আইনের হাত’। বহু আসল এই বাজার সৃষ্টি করেছেন বলেই বহু নকল উৎসাহিত হচ্ছেন চাহিদা জোগানের এই তত্ত্ব মেনে।

পুলিশের একজন সত্যিকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এমনকি সাধারণ একজন পুলিশ সদস্যও এই দেশে মানুষকে নিপীড়ন করার ক্ষমতা রাখেন। তাই পুলিশ পরিচয় দিলে তারা মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করে বিরাট উপার্জন নিশ্চিত করতে পারেন এবং বহু ক্ষেত্রে করেনও তাই। ভুয়া ডিবি পরিচয়ের ক্ষেত্রে আছে আরেকটি বড় ডাইমেনশন। একটি ‘সাদা মাইক্রোবাস’ আর কয়েকটি অস্ত্র থাকলে দিনে-দুপুরে যে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কাউকে সাদা পোশাকে গ্রেপ্তারের সময় অবশ্য পালনীয় হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও সেটা স্বয়ং পুলিশ বাহিনী কখনো মানে বলে শোনা যায় না। ফলে দেশের জেনুইন পুলিশ বাহিনীও সাদা পোশাকে বহু মানুষকে গুম করার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। এখন এই সুযোগটি নিচ্ছেন ভুয়া ডিবি পরিচয় প্রদানকারী লোকজনও। মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের ব্যবসা তাই এখন রমরমা।

এই দেশের প্রশাসনে দুর্নীতি এবং বেআইনি কার্যকলাপ এত বেশি যে সেটা এখন আর ব্যতিক্রমের পর্যায়ে নেই, এটাই এখন নিয়ম। প্রশাসনের এই চরিত্র এখন জানে দেশের সব মানুষ। তারা জানে উচ্চপদস্থ আমলা বা পুলিশ অফিসার চাইলে যে কাউকে যেকোনোভাবে অন্যায় সুবিধা এনে দিতে পারেন। যে কোনো আইনকে পাশ কাটাতে পারেন। এই কারণেই তাদের মূল্য সমাজে এখন এতই বেশি যে তদবিরের জন্য কোনো একজন ‘অতিরিক্ত সচিব’-এর সঙ্গে দেখা করতে মানুষ ১৫ হাজার টাকা ফি দিতেও প্রস্তুত থাকেন। একটা দেশের প্রশাসনযন্ত্র একদিনে বা এমনি এমনি এমন পচে যায় না। কখন প্রশাসনের চরিত্র এবং চেহারা কেমন হবে, তা নির্ভর করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের চরিত্র কেমন তার ওপরই।

দেশে বহু ভুয়া আমলা, পুলিশ অফিসার পাওয়া যাওয়া একটা উপসর্গ। এর রোগ নির্ণয় করতে গেলে আমরা দেখব এই দেশের ক্ষমতায় এখন যে দলটি আছে সেটির সীমাহীন দুর্নীতিই আজ সর্বব্যাপ্ত হয়েছে। প্রশাসনযন্ত্রকে নানা অন্যায়, অনিয়মে ব্যবহারের ফল হয়েছে প্রশাসনও এখন নিজেকে দায়মুক্ত এবং অতি ক্ষমতাধর জ্ঞান করে। সরকার যখন জবাবদিহিহীন হয় তখন প্রশাসন বা অন্যান্য রাষ্ট্রযন্ত্র জবাবের আওতায় থাকবে এটা ভাবা অমূলক।

লেখক আইনজীবী। সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION