সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৩২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

এই জিম্মিদশা থেকে কে বাঁচাবে

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ:
বরাবরই কিছু বিব্রতকর অবস্থা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর এমন অবস্থায় পড়লে বছর বিশেক আগের একটি ছবি মনে পড়ে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এখনকার মতো এত বড় যুদ্ধ না হলেও কমও ছিল না। পরীক্ষা ঘনিয়ে এলেই আমরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি। চেনাজানা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকেই মনে করেন আমরা চেষ্টা করলেই কাউকে ভর্তি করিয়ে দিতে পারি। ভরসা করে আমাদের কাছে আসেন। কেউ কেউ দাবি নিয়ে উপস্থিত হন। যতই বলি এখানে সাহায্য করার কোনো সুযোগই নেই। আমার মেয়ে পরীক্ষা দিলেও আমি নিশ্চিত থাকি না ও ভর্তির সুযোগ পাবে কি না! কেউ যুক্তি মানেন কেউ মনে করেন ‘দায়িত্ব’ এড়াচ্ছি। জোর করে ভর্তি প্রার্থীর রোল নম্বর দিয়ে যান। চলে গেলে এই অপ্রয়োজনীয় কাগজটি আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দিই। বিশ বছর আগে পরীক্ষা পদ্ধতি যন্ত্রনির্ভর ছিল না। চাইলে এক দুই নম্বর বাড়িয়ে সাহায্য করার সুযোগ ছিল। তবে শিক্ষকরা সাধারণত তা করতেন না। কারণ তারা জানতেন এক নম্বর দিয়ে কাউকে সাহায্য করলে একশ জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। সেই সময় দূরসম্পর্কের পরিচয়ের সূত্র ধরে এক ভদ্রলোক তার ছেলেকে নিয়ে এলেন। অনেক অনুরোধ করে গেলেন। তারা চলে গেলে যথারীতি রোল নম্বরের কাগজটি ফেলে দিলাম। এক সময় বিষয়টি ভুলেই গেলাম। যথারীতি পরীক্ষা হলো। ফলাফলও প্রকাশিত হলো। এরপর এক সন্ধ্যায় সেই ভদ্রলোক এলেন। হাতে দুই প্যাকেট মিষ্টি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, ‘আপনি চেষ্টা করেছেন বলেই ছেলে আমার ভর্তি হতে পেরেছে।’ আমি যতই বললাম আমার বিন্দুমাত্র সহযোগিতা নেই। ও নিজের যোগ্যতায়ই চান্স পেয়েছে। ভদ্রলোক ভাবছেন এ আমার বিনয়। আমি মিষ্টির প্যাকেটে তাকাই আর মরমে মরে যাই।

এখন একইভাবে বিব্রত হই কাগজে লিখি বলে। অর্থাৎ সংকটে পড়া চেনা-অচেনা অনেকেই মনে করেন আমাদের হাতে অনেক ক্ষমতা। কোনো সমস্যা নিয়ে কাগজে লিখলেই সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! তারা তাদের সংকটগুলো নিয়ে লিখতে অনুরোধ করেন। কিছু করতে পারি না বলে মনে মনে বিব্রত হই। আসল বাস্তবটি তারা বুঝতে চান না। তবে সাধারণ মানুষের আকুতি থেকে প্রকৃত সংকট গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ত্রাহি অবস্থা। সংশ্লিষ্ট সরকারপক্ষ সামাল দিতে চাইছেন না, না পারছেন না মানুষ ঠিক বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় ব্যবসায়ীদের কাছে পরাস্ত সরকার। আবার মনে হয় বাজার অনিয়ন্ত্রিত থাকছে একটি আপসরফার মধ্য দিয়ে। না হলে সরকারপক্ষ বারবার সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা না করে ব্যবসায়ীদের সংঘশক্তির কাছে মাথা নত করছে কেন! আবার এখানেও সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়েছে। কোনো সংঘবদ্ধ শক্তি নিজেদের স্বার্থ ইস্যুতে সংকট সৃষ্টি করতেই পারে। সংঘশক্তির দাবি পূরণ করতে গিয়ে যদি সাধারণ মানুষের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয় তবে সরকার কৌশলী অবস্থানে থাকে। নানা দরকষাকষি করে সব পক্ষের জন্য একটি সহনশীল সমাধানের পথ তৈরি করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকার পক্ষের আচরণ দেখলে মনে হয় তারা আসন্ন ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলা শক্তিকেই তুষ্ট রাখতে চায়। সাধারণ মানুষ সংঘবদ্ধ শক্তি নয়। তারা রাস্তাঘাট তথা সরকারকে অচল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তাই অমরাবতীতে বাস করা সরকারের বিধায়করা সাধারণ মানুষের দুর্দশার খবর রাখেন না বা রাখাটা জরুরি মনে করেন না বলে জনগণের ঘাড়েই খড়গ চালান। আমাদের সরকার পরিচালকদের একটি সৌভাগ্য বলতে হবে। একটি কঠিন ঘটনা বা অভিজ্ঞতার পর অল্প সময়ের ব্যবধানে সেই কঠিনকে ছাপিয়ে আরও জটিল ঘটনা বা স্খলন উপস্থিত হয়। ফলে আগের ঘটনার শবব্যবচ্ছেদের আগেই তা চাপা পড়ে যায়। যেমন সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে আপস করার পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠতে না উঠতেই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সংঘটিত হানাহানি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে সরব হতে হচ্ছে। কিন্তু সব কিছু তো আর ভুলে থাকা যায় না। আমাদের ক্ষতগুলো দেখিয়ে দিতে হচ্ছে অবহেলায় যাতে ক্যানসারে পরিণত না হয় সে আশঙ্কায়।

অতীতের যে কোনো সরকারের চেয়ে দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবল ধারা বজায় রাখতে পারছে বর্তমান সরকার। এক্ষেত্রে আমাদের মনে হয় এর কৃতিত্ব এককভাবে প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হয়। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা হয় চারপাশের অসহযোগিতা সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ দুর্গম করে তুলবে। করোনাকালের শুরু থেকে মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে সরকারি বিধায়কদের সখ্য যত বেশি ততটাই দূরত্ব সাধারণ মানুষের সঙ্গে। অর্থাৎ সরকার পক্ষ পরিবহন মালিকদের স্বার্থ ঠিক বলব না, অতিরিক্ত সুবিধা দিতে যতটা প্রস্তুত থাকে, ততটাই উদাসীন সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নটিতে। অসহায় মানুষ দেখেছে করোনাকালের শুরুতে স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য বাসে অর্ধেক সিট খালি রাখার নির্দেশ এসেছিল। তাতে ৫০ ভাগ নয় ৬০ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধির দাবি নিয়ে আসেন বাস মালিক ও শ্রমিকরা। দেখা গেল কোনো দরকষাকষির অবকাশ না রেখে রাতারাতি সরকার অনুমোদন করেছিল এ দাবি। যেন আগে থেকেই সব ঠিক করা ছিল। সরকার পক্ষের অমন সিদ্ধান্ত দিতে তো সমস্যা নেই কারণ ক্ষতিপূরণ সরকারের ভা-ার থেকে নয় সাধারণ যাত্রীর পকেট থেকেই যাবে। তা-ও অসহায় মানুষ মেনে নিয়েছিল।

কিন্তু এখন দেশ অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় বাস, লঞ্চগুলো আবার যাত্রী বোঝাই করে যাচ্ছে। তবুও ভাড়া কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেই। এর মধ্যে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আবার যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে তিন দিন অচল করে দিল সড়ক ও নৌপথ। ভেবেছিলাম এবার সরকার বলবে আগের বর্ধিত ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে। আবারও সরকারি মনোভাব দেখে মনে হলো সরকারই যেন পরিবহন মালিক পক্ষ। সাধারণ মানুষের ঘাড় মটকে আবারও ভাড়া বাড়িয়ে তুষ্ট করা হলো মালিক পক্ষকে। অতীত অভিজ্ঞতার মতো ভাড়া বৃদ্ধির হারের চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করা চলতে থাকল। আর যথারীতি সরকার পক্ষ দিতে থাকল হুঁশিয়ারি। ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়ার হাস্যকর হুমকি চলতে থাকল। পিষ্ট হতে থাকল সাধারণ মানুষ।

এই যে ইউপি নির্বাচনে এত অরাজকতা। রক্ত ঝড়ছে প্রতিদিন। খুন, ধর্ষণ আর সন্ত্রাসের কমতি নেই। এসব দেখে ভাবি আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা নানা চৌকস বাহিনীও নষ্ট রাজনীতির কাছে কত অসহায়! সরকারকেও কত অসহায় মনে হয় যখন প্রকাশ্যেই বড় বড় দুর্নীতি হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। সরকার এসবের মূলোচ্ছেদ তো দূরের কথা ডালপালাও ছাঁটতে পারছে না। সুশাসনের পথে না হেঁটে দলতন্ত্র জিন্দাবাদ ভাবলে এমন প্রতিফলই পাওয়া যাওয়ার কথা। কদিন ধরে পাঠকদের অনেকে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি নিয়ে লিখতে। আমি কাউকে কাউকে বলেছি আমাদের গণমাধ্যমে তো এ ব্যাপারে রিপোর্ট প্রচারিত হচ্ছে। তবু তাদের ধারণা আমরা কলামে লিখলে নাকি কাজ হবে। অর্থাৎ আবারও বিব্রতকর অবস্থায় পড়া। এই বিপন্ন মানুষগুলোকে কী করে বুঝাই আমরা ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার। আমি দেখছি এখন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কেমন অসহায় হয়ে পড়েছে। চেনাজানা অনেক মধ্যবিত্ত সচ্ছল পরিবারও সংকটে পড়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে অনেকে কভিডের প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের ব্যবসায় ধস নেমেছে। এখন তাদের অনেকেই পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন। জমানো টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমি নিজে মাসের বাজার সওদা করি না। গৃহকর্ত্রী বাজার থেকে ফিরে এখন প্রায়ই বলেন জমা খরচের হিসাব আর মেলাতে পারছেন না। বরাবর বাজেট ফেল করা সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্দশা এখন কেমন তা বুঝতে আর কঠিন অঙ্ক করার প্রয়োজন নেই।

করেনার প্রতিক্রিয়ায় বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের কল্যাণে সরকার হয়তো কাজ করছে। সে সংখ্যা কতটা জানি না। আমি তো চারপাশে সরকারি সহযোগিতা না-পাওয়া অনেক মানুষকেই অসহায় অবস্থায় দেখছি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কদিন কতজনকে সাহায্য করা যায়। গত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্নেহভাজন অধ্যাপক ফোন করলেন আমাদের ক্যাম্পাস লাগোয়া এক মহল্লায় তাদের গ্রামের এক ভদ্রলোক থাকেন। আগে ছোটখাটো চাকরি করতেন। অবসরে এখানে একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। ৬ জনের সংসারে আয় করার কেউ নেই। কভিডের প্রথম ধাক্কাতে দোকান বন্ধ হয়ে যায়। সামান্য পুঁজি ভেঙে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কারও কাছে হাত পাততে পারছেন না। সহকর্মী অনুরোধ করলেন খেয়ে-না-খেয়ে থাকা এই পরিবারের যাতে একটু খোঁজ নিই। না হয় নিলাম। কিন্তু কতদিন! ভদ্রলোক জানালেন কোনো প্রণোদনা সরকারিভাবে তিনি পাননি। প্রথম দিকে নাকি কিছু আর্থিক প্রণোদনা এসেছিল। তা দলীয় সমর্থকদের কাছেই চলে গেছে। চট্টগ্রামের পরিচিত একজন ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা জানালেন ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পমালিকদের নাকি সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছিল। তাও দলীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যেই বিতরণ করা হয়েছে। তা হলে যাবে কোথায় বিপন্ন মানুষ? সরকার পরিচালকদের মন খারাপ হলেও বলতে হবে দেশজুড়ে সন্ত্রাস, দখলবাজি, ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তরা বুক ফুলিয়ে চলছে। দুর্নীতিবাজরা কেবল টাকার পাহাড় বানাচ্ছে। চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সময়মতো ভোগ্যপণ্য আমদানি করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। এসবের কারণে এক বিরূপ প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এখন সাধারণ মানুষ সব ক্ষমতাসীনদের বলয়ে যেন আটকে গেছে। এই জিম্মিদশা থেকে তাদের কে বাঁচাবে!

লেখক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION