সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৩৮ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কালের আলোয় মওলানা ভাসানীর সংগ্রামী জীবন

গাজী তানজিয়া :
ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী শীর্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন যতটা দীর্ঘ, ততটাই সংগ্রামবহুল। তিনি প্রায় ৬৫ বছর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে দেশের আপামর গণমানুষের স্বার্থরক্ষায় অবদান রেখেছেন। মওলানা ভাসানী তার জীবদ্দশায় কেবল বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশে নয়, দীর্ঘকাল ধরে খ্যাত ছিলেন আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মজলুম মানুষের সংগ্রামে প্রেরণার দীপশিখা হিসেবে। গণমানুষের সেই কালজয়ী মহান নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে পশ্চিমী দুনিয়ার গণমাধ্যম ‘ফায়ার ইটার’ বা ‘অগ্নিভুক’, ‘রেড মওলানা অব দ্য ইস্ট’ অর্থাৎ ‘প্রাচ্যের লাল মওলানা’ ইত্যাকার বিশেষণে চিত্রিত করে। টাইম ম্যাগাজিন যখন তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে; শিরোনাম দিয়েছে ‘প্রোফেট অব ভায়োলেন্স’ বা ‘সহিংসতার পথপ্রদর্শক’। একই সঙ্গে তিনি স্টকহোম আফ্রো-এশীয় শান্তি সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছেন এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য শান্তির পৃথিবীর কথা বলেছেন। নির্যাতিত মানুষ বরাবরই তাকে শ্রদ্ধা করে এসেছে উৎপীড়নবিরোধী সংগ্রামের মহানায়ক হিসেবেই। ঔপনিবেশিক আমলে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

তার বর্ণাঢ্য সংগ্রামী জীবনে তিনি জমিদার-জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, আসামে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই, অবিভক্ত ভারতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম, পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ‘আওয়ামী লীগ’ বা ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’র মতো রাজনৈতিক দল গঠন। কৃষক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক আন্দোলনে। লড়াই জারি রেখেছেন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। করেছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে ‘এনআরসি’ সংকট যখন নতুন রূপ পেয়েছে তখন আসামে মওলানা ভাসানীর লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাওয়াখোলা মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানীর নাম বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ এত বিশাল কৃষক সম্মেলন শুধু বাংলায় নয়, গোটা উপমহাদেশে তার আগে কখনো হয়নি। বাংলার মহাজনী ঋণে জর্জরিত কৃষকরা যে সংঘটিত হতে পারে, ওই সম্মেলনে তিনি তার প্রমাণ করেছিলেন। ‘খাজনা বন্ধ’ আন্দোলনে তিনি সফলতা অর্জন করলে বাংলা জোতদার, জমিদারদের ষড়যন্ত্র ও তোপের মুখে তাকে বাংলা ছেড়ে আসামে পাড়ি জমাতে হয়। চল্লিশের দশকে আসামে লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মওলানা ভাসানী। উনিশ শতকের প্রথম দশক থেকে অবিভক্ত ভারতে বাংলার ময়মনসিংহ, রংপুর, কুচবিহার, ত্রিপুরা ও সিলেট থেকে লাখ লাখ ভূমিহীন কৃষক আসামের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় গিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। তারা প্রধানত আসামের গোয়ালপাড়া ও নওগাঁ জেলা, দরঙ্গ জেলার মঙ্গলদই সাব-ডিভিশন এবং কামরূপ জেলার বারপেটা সাব-ডিভিশনের জঙ্গল আবাদ করে ফসল ফলায়। এর আগে কালাজ্বর রোগে আসামের বহু লোক মারা যাচ্ছিল। অন্যদিকে, নতুন আগত এই কৃষকদের হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে আসামের হিংস্র শ্বাপদের বিচরণক্ষেত্র মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়। প্রথম প্রথম আসাম সরকার নবাগতদের সাদরে অভ্যর্থনা জানায়। কিন্তু ক্রমাগত তাদের সংখ্যা বেড়ে গেলে অসমীয়রা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আসাম সরকারকে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। অনেক জায়গায় বহিরাগতদের সঙ্গে জমি নিয়ে তাদের বিরোধ বাধে। এই সংঘর্ষ নিবারণ করার উদ্দেশ্যে আসাম সরকার লাইনপ্রথা প্রবর্তন করে। এই প্রথা অনুযায়ী নবাগতদের অধিকারযোগ্য ভূমির সীমারেখা বা লাইন টেনে দেওয়া হয়। ফলে বিভিন্ন জেলার নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে নবাগতরা যেতে পারত না। এই কুখ্যাত লাইন প্রথার বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। শুরুতে তিনি বহিরাগতদের সমস্যা নিয়ে কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে কোনো সুফল পাওয়া না গেলে, শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নেন সংগ্রাম করার। তার মতে, ‘সংগ্রামই জালেমের জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ।’ তিনি সরকারের দমননীতির প্রতিবাদ করার জন্য বাঙালি কৃষকদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন। তিনি ‘আসাম চাষি-মজুর সমিতি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, সভাপতি ছিলেন ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুল হক। এই সমিতি ১৯৩০-এর শেষ দিকে বছর তিনেক লাইন প্রথার বিরুদ্ধে নানা জায়গায় সভা-সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানায়।

পূর্ববঙ্গের মানুষ অন্য কোনো স্থানে না গিয়ে আসাম যাওয়ার কারণ শুধু অর্থনৈতিক ছিল না। ছিল জাতিগত এবং সাংস্কৃতিকও। আসামের দক্ষিণ অংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শত শত বছর ধরে ছিল বাঙালিদের আবাস। সেখানে অসমীয়া আদিবাসীদের তুলনায় বাঙালি সব সময় বেশি ছিল। ১৯০১ সালের আদমশুমারির হিসাবে আসামের মোট জনসংখ্যা ছিল ৬১ লাখ ২৬ হাজার ৩০০। এর মধ্যে বাঙালি ছিল ২৯ লাখ ৪৮ হাজার ২০০। অসমীয় ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ এবং অন্যান্য ভাষাভাষী ১৮ লাখ ২৮ হাজার ৩০০ জন।

তিরিশের দশকে আসামে অনেক ছোট ছোট আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, তবে জাতীয় কংগ্রেসই ছিল সেখানে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী। এদিকে আব্দুল মতিন চৌধুরী সেখানে মুসলিম লীগ সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন, কিন্তু তিনি বেশিদূর এগোতে পারেননি। ভাসানী কৃষকদের মধ্যেই তখনো কাজ করছিলেন। তিনি একসময় মতিন সাহেবের সঙ্গে মুসলিম লীগ সংগঠনের কাজে নেমে পড়েন এবং রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে অনেক দল আসাম প্রদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। মওলানা ভাসানী দক্ষিণ ধুবড়ী থেকে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। নবনির্বাচিত আইন সভার প্রথম অধিবেশন মাত্র ৩ দিন চলেছিল। কাজেই সে অধিবেশনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপিত হতে পারেনি। দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ৩ আগস্ট। এ অধিবেশনে লাইন প্রথাই প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। ১৯৩৭/৩৮ সালের মধ্যে আসামে লাইন প্রথা নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ আন্দোলন চলেছিল দীর্ঘ ১০ বছর। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত।

১৯৪০ সালের ২ এপ্রিল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এক সভা করিমগঞ্জ টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়। আসামের বাঙালি কৃষক নেতারা তাতে যোগ দেন। সভাপতির ভাষণে ভাসানী যথারীতি লাইন প্রথা বিলোপের জোর দাবি জানান। অভিবাসীদের ওপর অত্যাচার বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। আসামের শিলংয়ে তীব্র শীতের মধ্যেও ভাসানী লুঙ্গি পরে জনসভায় যেতেন। লাইনপ্রথার প্রতি গোটা ভারতের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেন তিনি। ১৯৪৪ সালের ২১ ডিসেম্বর এক সমাবেশে মওলানা বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত উপমহাদেশের মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।’ ১৯৪২ সালে এক জনসমুদ্রে দেওয়া ভাষণে তিনি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ৩১ মার্চের মধ্যে, লাইনপ্রথা বিলোপ না হলে তিনি এপ্রিল থেকে ‘আইন অমান্য’ আন্দোলন শুরু করবেন। সেই সম্মেলনে ভাসানীর উত্তেজনাপূর্ণ ভাষণে সরকারের ভীতির সঞ্চার হয় এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকার তাকে এই মর্মে চিঠি দেয় যে, পরবর্তী এক বছর ভাসানী আর কোনো সমাবেশ করতে পারবেন না। ওই সম্মেলনের চারদিন আগে গোয়ালপাড়া জেলার বাঁশকাটায় অপর এক জনসভায় সভাপতিত্ব করার সময় ভাসানী জনগণকে সরকারের যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যাপারে কোনোরকম সহযোগিতা না করার আহ্বান জানান। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে ‘আগস্ট আন্দোলন’-এর আগে আসামে ভাসানী একাই ব্রিটিশ শাসকদের অস্থির করে রেখেছিলেন। ভাসানীর আন্দোলনের ফলে সাদ উল্লাহর মন্ত্রিসভা সংকটে পড়ে এবং বাধ্য হয়ে তখন অন্তত এক লাখ বহিরাগত কৃষককে জমি বরাদ্দের কথা ঘোষণা করে। ভাসানী গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, ‘১৯৩৭ সাল থেকে আসামে লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িয়ে না পড়লে এবং সেখানকার সর্বহারা কৃষকদের নেতৃত্ব না দিলে ভাসানী হয়তো তখন আরও বৃহত্তর পটভূমিতে উপমহাদেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে পারতেন।’

লেখক : কথাসাহিত্যিক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION