সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১৫ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম

ইসলাম। ফাইল ছবি।

শাহীন হাসনাত:
মানবতার ধর্ম ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানুষের দেহ-মনকে পূতপবিত্র, উদার ও মহৎপ্রাণ করে তোলে। যা কিছু সত্য, সুন্দর ও কল্যাণকর, তা-ই ইসলামের শিক্ষা। ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণীর উদ্দেশ্য, মানুষের আদর্শ জীবন গঠন। কেননা আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়ে মানবজাতিকে তাদের মাধ্যমে দিয়েছেন নৈতিক শিক্ষা।

মানুষের সৎভাবে জীবনযাপনের জন্য ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। জ্ঞান ছাড়া সচেতনতা আসবে না আর গণসচেতনতা ছাড়া সক্ষমতা আসবে না। ধর্মের শিক্ষা কর্মের জন্য; তা যদি মানুষকে অনৈতিকতা ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে বিরত রাখতে না পারে, তাহলে এতে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। বর্তমানে অনৈতিকতা ও অসাধুতা যে সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বর্তমান সমাজের মেরুদ-ে যেন ঘুণে ধরেছে। সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধহীনতা ও ক্ষয়িষ্ণুতা মারাত্মভাবে বেড়েছে। ধর্মের প্রতি অনীহা এবং বিবেক বর্জিত হওয়ার কারণে অসৎ লোকেরা নানা ধরনের অন্যায় ও অপকর্মে জড়াচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে দক্ষ, অভিজ্ঞ, নীতিমান ও সৎ লোকের খুবই অভাব। নকল, ভেজাল, প্রতারণা আর কারচুপি হয়ে উঠেছে সামাজিক ও বাণিজ্যিক লেনদেনের পদ্ধতি।

সমগ্র দেশবাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, পণ্যদ্রব্য ও ওষুধপথ্য ক্রয়ের প্রাক্কালে প্রতারিত ও বিপদগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। বাড়তি মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা এমন সর্বনাশা বক্রপথে পা বাড়িয়েছেন।

সমাজের কপট লোকদের রাশ টানতে, অসাধুদের লাগাম দিতে, অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করতে, সমাজব্যবস্থা শান্তিময় করতে দরকার জবাবদিহি। এটা ইসলামের একটি অন্যতম মৌলিক বিষয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ’ -সহিহ বোখারি

জবাবদিহি ইসলামের সৌন্দর্য, এ কারণে তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে। যদি প্রত্যেক মানুষ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে সজাগ হতো ও আখেরাতে জবাবদিহির অনুভূতি তীব্রতর হতো, তাহলে সমাজের সিংহভাগ অভিযোগ ও সমস্যা বিদূরিত হতো। কারণ, মানবজীবনে অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ জবাবদিহির অনুভূতি না থাকা। জবাবদিহি দুই প্রকার, মানুষের কাছে জবাবদিহি এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহি। মানুষের কাছে জবাবদিহির অনুভূতি কমে গেলে মানুষ যত না বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আল্লাহর কাছে জবাবদিহির অনুভূতি বিলুপ্ত হলে। কেননা ‘আল্লাহর কাছে জমিন ও আসমানের কোনো কিছুই গোপন থাকে না। ’ -সুরা আলে ইমরান : ৫

পরকালে দুনিয়ার প্রত্যেক কাজের জবাবদিহি করতে হবে মানুষকে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কেউ এক কদম সামনে অগ্রসর হতে পারবে না। ১. কীভাবে সে তার জীবনকে অতিবাহিত করেছে? ২. তার যৌবনকে সে কীভাবে ব্যয় করেছে? ৩. সে কীভাবে অর্থ সম্পত্তি আয় করেছে? ৪. অর্জিত অর্থ সম্পত্তি কোন পথে ব্যয় করেছে? এবং ৫. সে তার জ্ঞানের আলোকে কী করেছে? তিরমিজি

মূলত এ পাঁচটি প্রশ্নের মধ্য দিয়ে মানবজীবনের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সবার কাছে প্রত্যেক বিষয়ের হিসাব নেওয়া সম্ভব। এসব প্রশ্নের উত্তর তখনই যথাযথভাবে দেওয়া যাবে, যখন ব্যক্তি তার জীবনকে আল্লাহর দেওয়া বিধানের আলোকে এবং রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথে পরিচালিত করতে সচেষ্ট হয়।

সত্যিকার অর্থে কীভাবে এ জীবনকে কাজে লাগিয়ে আখেরাতের জীবনে সফলতা নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাপারেও হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কার্যকর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পাঁচটি বিষয়ের আগে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দাও। ১. বৃদ্ধ হওয়ার আগে তোমার যৌবনকে, ২. অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থতাকে, ৩. দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতাকে, ৪. ব্যস্ততার আগে অবসর সময়কে এবং ৫. মৃত্যুর আগে জীবনকে। -আহমদ

জবাবদিহির অনুভূতি ও দায়িত্বানুভূতির তীব্রতা মুসলিম নেতাদের মধ্যে কেমন ছিল, তা দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর একটি ঘটনা থেকে বুঝা যায়। একদিন তিনি প্রচ- সূর্যতাপে সদকার উটের পরিচর্যা করছিলেন। এমন সময় বনু তামিমের নেতা আহনাফ বিন কায়েস ইরাক থেকে একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আসেন। যখন তারা নিকটবর্তী হলেন, তখন খলিফা ওমর (রা.) আহনাফকে ডেকে বললেন, হে আহনাফ! কাপড়-চোপড় ছেড়ে দ্রুত এসো এবং এই উট পরিচর্যার ব্যাপারে আমিরুল মুমিনিনকে সাহায্য করো। কেননা এগুলো সদকার উট। এর মধ্যে এতিম-মিসকিন ও বিধবাদের হক রয়েছে। তখন একজন বলল, হে আমিরুল মুমিনিন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। সদকা খাতের কোনো একজন গোলামকে এ কাজের নির্দেশ দেওয়াই তো আপনার জন্য যথেষ্ট ছিল। জবাবে হজরত ওমর (রা.) বললেন, আমার ও আহনাফের চেয়ে বড় গোলাম আর কে আছে? কেননা যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোনো দায়িত্বে থাকে তার ওপরে ওইরূপভাবে দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব, যেভাবে একজন মনিবের প্রতি গোলামের দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব। ’ -ইবনুল জাওযি

ইসলামি স্কলারদের মতে, বয়স, যোগ্যতা ও পদমর্যাদা হিসেবে মানুষের জবাবদিহির তারতম্য হয়। সুতরাং সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। ইসলামে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ইহকালীন ও পারলৌকিক উভয় জগতেই লক্ষ করা যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘অনন্তর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে (জবাবদিহি) ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস। ’ -সুরা নাজিয়াত : ৪০

ইসলাম মতে, পরকালে আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান ও মর্যাদাপ্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আত্মসচেতন, কর্তব্যপরায়ণ ও কর্মতৎপর হতে হবে। নিজেকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত করে তুলতে হবে।

মানবজীবন জবাবদিহির একটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা। এটি ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ বয়ে আনে। এ জন্য সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, নিরপেক্ষতার সঙ্গে সবাইকে সমাজজীবনে যথাযথভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকলে সর্বমহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি বেড়ে যায়। তাই জাতীয় জীবনে প্রত্যেক মানুষকে লোভ-লালসা ও ভোগ-বিলাসিতার মাধ্যমে নয়, বরং ন্যায়নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION