সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

‘আমার বউ আমি পেটাব তাতে কার কী’

চিররঞ্জন সরকার:
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী পালন করা হলো ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে শুধু এই ১৫ দিনের প্রচারাভিযানই নয়, বছরজুড়েই আরও নানা উদ্যোগ-আয়োজন-কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এজন্য আছে অনেক আইন, বিশেষ ব্যবস্থা। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। নারীরা ঘরে-বাইরে সবখানে নির্যাতিত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে ঘরে, স্বামীর হাতে।

যেকোনো মানুষের কাছেই পরিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আশা-ভরসার স্থল, নিরাপদ আশ্রয়। দিন শেষে সবাই পরিবারের কাছেই ফেরে। কেননা, এটাই শান্তির ঠিকানা। আর এই পারিবারিক পরিসরেই যদি নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তার চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে? আমাদের দেশে কিন্তু এমনটাই ঘটছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতাসংক্রান্ত জরিপ ২০১৫ অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ বিবাহিত নারী তাদের স্বামীর শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। যার মধ্যে ৫০ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা স্বামী কর্র্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতনের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরও অনেক বেশি বলেই গবেষকরা মনে করেন। বাস্তবতা হলো, গ্রামেগঞ্জে লেখাপড়া না জানা মেয়েরা তো বটেই, শহুরে শিক্ষিত মেয়েরাও স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কেউ মার খেয়েও মুখ বুজে সহ্য করছেন, কেউবা অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। যারা নারী নির্যাতন করেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের এই হিংস্র চেহারা বাইরের মানুষের কাছে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন। যার সঙ্গে প্রতিদিন পাশের ডেস্কে বসে কাজ করছেন, বাইরে ভদ্র ব্যবহার করেন, তিনিই যে বাড়িতে ফিরে বউকে পেটান বা পেটাতে পারেন, সেটা অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বউ পেটানো আমাদের দেশে খুবই সাধারণ একটা ঘটনা। ‘নিজের বউকে নিজে মেরেছি, কার তাতে কী?’, ‘এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার’ অনেক পুরুষের মুখে এমন কথা শোনা যায়। তারা মনে করেন, বউ মানেই নিজের সম্পত্তি, তার সঙ্গে যেকোনো অন্যায়, অবিচার ও অপরাধ করার অধিকারও তার আছে। চার দেয়ালের ঘর থেকে শুরু করে রাস্তা, পাবলিক প্লেস, সব জায়গায় শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব স্বামীই যেন তা করতে পারেন।

আমাদের দেশে বেশিরভাগ স্বামী বিশ্বাস করেন, তাদের অধিকার আছে স্ত্রীকে শাসন করার বা তাকে নিয়ন্ত্রণ করার। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, অনেক স্ত্রীও মনে করেন, স্বামী যেহেতু পরিবারের কর্তা এবং ভরণপোষণ প্রদান করেন, সেহেতু তিনি একটু শাসন করতেই পারেন। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও নারীদের একটা বড় অংশ বউ পেটানো সমর্থন করেন। ভারতের ১৪টি রাজ্যের ৩০ শতাংশ নারীই মনে করেন বউ পেটানো ঠিকই আছে। নির্দিষ্ট কারণ আছে বলেই স্বামীর হাতে মার খান স্ত্রীরা। সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা মেয়েদের চিন্তা-চেতনাকেও যে কতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এই গবেষণা প্রতিবেদন তারই দৃষ্টান্ত। আমাদের প্রথা, সামাজিক ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টিকে মেনে নিয়েছে, যা এ ধরনের চর্চাকে আরও বেশি উৎসাহিত করছে। ধর্মীয় বিধানের অপব্যাখ্যাও এর জন্য দায়ী। আসলে দীর্ঘদিন পুরুষশাসিত সংসারে বাস করে নিজেদের অধিকারবোধ সম্বন্ধে অনেক নারীই যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠতে পারেননি। যুগ যুগ ধরে জেনে এসেছেন, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির প্রতি আনুগত্যই একজন মেয়ের জীবনের শেষ কথা। তারা এখনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকেই মনেপ্রাণে লালন করছেন, যার পরিণতিতে নারীর প্রতি অবিচার, অত্যাচারকে বিনা বাক্যে সমর্থন করেছেন। বউকে মারা বা নির্যাতন করা পুরুষদের অধিকার বলেই তারা বিশ্বাস করেন। এই কূপম-ূকতার বাইরে তারা আর বেরিয়ে আসতে পারছেন না। সংসারে তাদেরও যে মতপ্রকাশের এবং নিজেদের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে, এই বোধ হয়তো তাদের নেই। আসলে জন্ম থেকেই সমাজ বদ্ধমূল তাদের মধ্যে ধারণা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে যে, তুমি নারী। তুমি অপূর্ণ। পুরুষই তোমাকে পূর্ণত্ব প্রদান করতে পারে। সেই হিসাবে স্ত্রীকে পেটানোও পুরুষের অধিকার বলেই তারা বিশ্বাস করে আসছেন। একুশ শতকে এ যেমন লজ্জাজনক, তেমনই চরম হতাশাজনকও বটে। অনেক ক্ষেত্রে বেকারত্ব, হতাশা, পেশি অথবা অর্থশক্তিতে বলবান কারও কাছে অবমাননা মুখ বুজে সহ্য করে ঘরে ফিরে পুরুষ তার পৌরুষ ফলায় ঘরের নারীর ওপর, যেখান থেকে প্রত্যাঘাতের আশঙ্কা নেই বললেই হয়।

হীনম্মন্যতা ও হতাশা থেকে অনেক পুরুষ এমনটা করেন। সফল মানুষরা কেন স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন, এ বিষয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে। এর উত্তর হলো শুধু বস্তুগত, বৈষয়িক কারণে স্ত্রীকে পেটান, তা নয়। যৌন জীবনে অসুখী, ব্যক্তিত্ব নিয়ে হীনম্মন্যতা, অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, এসবের কারণেও স্ত্রীকে পেটান তারা। কোনো কোনো পুরুষ ঈর্ষা থেকেও এ ধরনের অপরাধ করেন।

অনেক পরিবারেই স্ত্রীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক অন্যায় আচরণ করা হয়। যেসব পরিবারে স্বামী, স্ত্রী উভয়েই কাজ করতে যান, তারা যখন কর্মস্থল থেকে ফিরে আসেন, তখন বাড়ির পুরুষ সদস্যটির সঙ্গে যেরূপ আচরণ করা হয়, অনুরূপ আচরণ মেয়েটির সঙ্গে করা হয় না। বাড়ি ফেরার পর রান্নাঘরে মেয়েটি স্বেচ্ছায় গেলেও তার কাজের কোনো স্বীকৃতি তো দেওয়া হয়ই না, সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি হলেই মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। অনেক জায়গাতেই মেয়েসন্তানের সঙ্গে ছেলেসন্তানের খাওয়াদাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুতেই বিভাজন করা হয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার।

আমাদের সমাজে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হয় যেভাবেই হোক, সংসার টিকিয়ে রাখতে হবে। পরিবারের সম্মান হারানো যাবে না। এ ধরনের ক্ষেত্রে নারীরা এক চরম দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কারও কারও অর্থনৈতিক ঝুঁকি থাকে, সেটাও বড় কারণ। তার চেয়ে বেশি থাকে সামাজিক সম্মানহানির ঝুঁকি। দেখা যায়, নারীরা পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র বা রাষ্ট্রে কোথাও সেই অর্থে সমর্থন পান না। অন্যদিকে দমনপীড়নের একটা মানসিকতা অনেক পুরুষের মধ্যে এমনিতেই গড়ে ওঠে। সেসব পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য পারিবারিক শিক্ষাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও। তাহলেই তিনি নারীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শিখবেন। নারীদের সুশিক্ষাও বড় বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন এ নারীদের নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করা, যাতে তারা পুরুষতান্ত্রিকতার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০১০ সালে প্রণীত পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনে পারিবারিক পর্যায়ে নারী নির্যাতন ও সহিংসতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যদিও আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা আশানুরূপভাবে কমছে না। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের প্রভাব পরিবারগুলোতে পড়েছে। যে শিশু মা-বাবার ঝগড়া, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব দেখে বেড়ে ওঠে, বড় হয়ে তার মধ্যেও সঙ্গীকে নির্যাতনের প্রবণতা দেখা দেয়। যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে, ‘অবজারভেশনাল লার্নিং’। ফলে শিশুকে ছোট থেকেই অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তুলতে হবে। নারীর আর্থসামাজিক অবস্থান উন্নত হলেই নির্যাতন কমবে, এমন ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। কেননা রাষ্ট্রের পরিচালনা-পদ্ধতি, মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন না এলে নারীর যতই ক্ষমতায়ন হোক, ঘরে বা বাইরে তার ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে না। সঠিক শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে গ্রামের এমনকি শহুরে কোনো কোনো নারী মনে করেন, স্বামী গায়ে হাত তুলতেই পারে। স্বামীই তো, একবার লাথি মারবে, আরেকবার বুকে টেনে নেবে। এই ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে আধুনিক সময়েও ঘরে ঘরে বর্বরতার শিকার হবেন তারা।

দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে তদানীন্তন সরকার নারী উন্নয়নকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। দেশে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে মহিলা ও শিশুবিষয়ক একটি পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে নারী উন্নয়ন নীতিমালাসহ আরও অনেক নারীবান্ধব পদক্ষেপ। তবু নারীমুক্তির পথ কেন আজও সুদূরপরাহত এ প্রশ্নই উঠে আসে বারবার। এ প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পেতে হবে। একই সঙ্গে ‘আমার বউ আমি পেটাব তাতে কার কী’ এ ধরনের আত্মঘাতী নেতিবাচক মানসিকতা থেকে পুরুষদের সরে আসতে হবে। যেকোনো ধরনের নারী নির্যাতন বা বউ পেটানো যে একটা গর্হিত কাজ, অন্যায় এবং অপরাধ, এটা পুরুষ ও নারী উভয়কেই বুঝতে হবে।

লেখক লেখক ও কলামনিস্ট chiros234@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION