সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩০ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ভার্চুয়াল দুনিয়ার শিষ্টাচার

শায়খ ড. আবদুল বারী বিন আওয়াজ আস সুবাইতি:

সহিহ বোখারিতে হজরত আবু সাঈদ আল খুদরি রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা রাস্তার ওপর বসা থেকে বিরত থাকো। লোকজন বলল, এ ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। কেননা, এটাই আমাদের মজলিস (উঠাবসার জায়গা) এবং এখানেই আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। তিনি বলেন, যদি তোমাদের সেখানে বসতেই হয়, তবে রাস্তার হক আদায় করবে। তারা বলল, রাস্তার হক কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি অবনত রাখা, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করা।’

ইসলাম প্রত্যেক হকদ্বারকে তার হক প্রদান করেছে এবং রাস্তাসমূহের ওপর বসার জন্য কতগুলো আদব নির্ধারণ করে দিয়েছে যা রাস্তা, বৈঠক ও যৌথ হকের আদবকে অন্তর্ভুক্ত করে। রাস্তার ওপর বসার সদৃশ হলো, বর্তমান আমাদের যুগে বহুল প্রচলিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভার্চুয়াল মিটিংসমূহ। যা সীমারেখাকে অতিক্রম করেছে, সুরক্ষাবলয়কে ভেদ করেছে এবং এর প্রভাব সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। সব মানুষের জন্যই তাতে নানাবিধ জ্ঞানের উৎস রয়েছে, সেখান থেকে তারা সংবাদ সংগ্রহ করে, এর প্লাটফর্মগুলোতেই তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং পরস্পরে চিন্তা-ভাবনা বিনিময় করে। এ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে তাদের কারও কারও সম্পর্ক মজবুতির স্তর পেরিয়ে আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বরং সে অনুভব করে যে, এ মাধ্যমগুলো ছাড়া তার কোনো অস্তিত্ব নেই এবং এটা ছাড়া তার জীবনযাপন সুখময় নয়। ফলে ব্যক্তি তার আত্মসত্তাকে ভুলে গেছে, সামাজিক সম্পর্ক এবং পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে মন্দ বিষয় হলো, সৃষ্টিকর্তা ও নেয়ামতদাতা আল্লাহর হক আদায়ে ত্রুটি করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে আল্লাহ তাদের আত্মবিস্মৃত রেছেন।’ -সুরা আল হাশর: ১৯

এই মাধ্যমগুলোতে কল্যাণ ও জ্ঞানের মজলিসও রয়েছে, যা বুদ্ধি-বিবেককে সমৃদ্ধ করে এবং শিক্ষাকে বিকশিত করে। বুদ্ধিমানেরা এ ধরনের মজলিসের অভিমুখী হয়। ফলে তাদের ইমান বৃদ্ধি পায় ও চরিত্র উন্নত হয়। আবার এ মাধ্যমে এমন মজলিসও রয়েছে যা আকিদাকে নড়বড়, ইমানকে দুর্বল, হারামসমূহ লঙ্ঘন, চরিত্রকে কলুষিত এবং মর্যাদা ও লজ্জাশীলতাকে অপবিত্র করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মন্দ চিত্রের অন্তর্গত হলো, অন্যের মান-সম্মানে আক্রমণ, তাদের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান, তাদের চরিত্র হনন এবং চিত্রধারণ কিংবা অন্য উপায়ে অসম্মান করা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের জান-মাল, সম্মান ও চামড়া একে অপরের জন্য তেমন হারাম; যেমন এ নগরে এ মাসের এ দিনটি তোমাদের জন্য হারাম।’ -সহিহ বোখারি

এ ছাড়া জাহেলিয়াতপূর্ণ সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়া, বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের নিন্দা করা; যা ভ্রাতৃত্ববোধের মর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, জাতীয় সংহতিকে ধ্বংস করে, অন্তরগুলোকে বিদ্বেষে পরিপূর্ণ করে এবং শক্রতাকে জাগিয়ে তোলে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে বেশি তাকওয়াসম্পন্ন।’ -সুরা আল হুজুরাত: ১৩

এর আরও কিছু মন্দ দিক হলো, যা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা বা মানুষের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার এবং খারাপ কাজের বিস্তারের দিকে নিয়ে যায়; এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ এর সমালোচনা করতে গিয়ে অবচেতনভাবে ওইগুলো প্রচারে অবদান রাখে। এতে রয়েছে শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিপক্ষে প্ররোচনা, গুজব ও মিথ্যার প্রচার-প্রসার এবং বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ানোর মতো বিষয়ের উপস্থিতি। দ্বীনি বিধিবিধানের বিপরীত কর্মকা-ের উপস্থিতি। যেমন হারাম ছবি আদান-প্রদান ও অবক্ষয়মূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। এগুলো সবই মজলিসের শিষ্টাচার পরিপন্থী। এগুলোতে অংশগ্রহণকারী হারামে নিপতিত এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগী হিসেবে গণ্য হবে।

এসব ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অসতর্কতা দীর্ঘ অকল্যাণের মধ্যে নিপতিত করে। যেমন সুপ্ত ফেতনার আগুনকে প্রজ¦লিত এবং খারাপ রীতি চালু করা। যা পরবর্তীরা অনুসরণ করে। ফলে এগুলোর পাপ এবং জাতি পরম্পরায় যতদিন পর্যন্ত এর ওপর আমল অব্যাহত থাকবে তাদের সবার পাপ তার ওপর বর্তাবে তার জীবদ্দশায় ও মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে কবরে যাওয়ার পরও। মানুষেরা এর ওপর আমল করা থেকে বিরত হওয়া ছাড়া তার পাপ বন্ধ হবে না।

এ মাধ্যমগুলোর আরও একটি খারাপ দিক হচ্ছে, এমন বিষয়ে সময় ও জীবন বিনষ্ট হয় যাতে কোনো উপকার ও সুফল নেই; যা কেবল বিশুদ্ধ অন্তর ও বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিরাই অনুধাবন করতে পারে। বয়স, জীবন ও অন্যান্য কল্যাণমূলক বিষয় সবই সময় সংশ্লিষ্ট; যদি সে সময়কে বিনষ্ট করে তাহলে তার কল্যাণ বিনষ্ট হয়ে যায়, আর যদি সময়কে হারিয়ে ফেলে তবে কখনো তা আর ফিরে আসে না।

যে ব্যক্তি এমন বৈঠকে বসতে পছন্দ করে যেখানে আল্লাহর আয়াতের সঙ্গে কুফরি ও তাচ্ছিল্য করা হয় এবং দ্বীনের সম্মানহানি করা হয়। বস্তুত সে তাদেরই দলভুক্ত। তাই এ ধরনের বৈঠকে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আপনি যখন তাদের দেখেন, যারা আমার আয়াতসমূহ সম্বন্ধে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয়, তখন আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গ শুরু করে। আর শয়তান যদি আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তবে স্মরণ হওয়ার পর জালেম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসবেন না।’ -সুরা আল আনআম: ৬৮

বিচক্ষণ ব্যক্তি মাত্রই জানেন, এ ধরনের বৈঠকে তারাই কথা বলে যারা এর যোগ্য নয়। বরং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে এবং অন্যের স্থান গ্রহণ করে বসে; একজন বিনা ইলমে ফতোয়াবাজি করছে তো অন্যজন চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন ছাড়াই ডাক্তারি করছে, আরেকজন সাধারণ জনগণের বিষয়ে কথা বলছে! বড় পরিতাপের বিষয় হলো, এগুলোই ফেতনাগ্রস্ত অনেকের কাছে তথ্যগ্রহণের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। উপরন্তু এসব মিটিংয়ে পরনিন্দা, চোগলখুরি, অশ্লীলতা ও অপবাদের চর্চা হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তা-ই বলে বেড়ায়।’ -সহিহ মুসলিম

অতএব মুসলমানদের ওইসব লোকদের থেকে সতর্ক থাকা উচিত, যারা তাকে তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যম বানাতে চায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সেই দিনের তাকওয়া অবলম্বন করো, যেদিন তোমাদের আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তারপর প্রত্যেককে সে যা অর্জন করেছে তা পুরোপুরি প্রদান করা হবে।’ -সুরা আল বাকারা : ২৮১

এ সব প্লাটফর্মের ব্যাপারে জনসচেতনতামূলক ও দিকনির্দেশনামূলক প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ দায়িত্বশীলদের কাছে প্রত্যাশিত বিষয়। যা হৃদয়গুলোতে আল্লাহর তাকওয়ার বীজ বপন করবে এবং দ্বীনি মূল্যবোধ ও নৈতিক চরিত্রকে শক্তিশালী করবে। সেইসঙ্গে সন্দেহজনক সাইট এবং এ জাতীয় প্লাটফর্মের মাধ্যমে মন্দের প্রচারণায় জড়িত কোম্পানিগুলোকে বর্জন করবে।

২৮ অক্টোবর মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা।/অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION