সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪০ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ইসলামের ইতিবাচক উপস্থাপনায় কাতার

মুহাম্মদ আতিকুর রহমান:

বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে কাতারে আসা বিদেশি দর্শকদের কাছে ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য তুলে ধরতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছেইসলামি সংস্কৃতিবিষয়ক বিভিন্ন বইপত্র। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইসলাম’ নামে ছয় ভাষায় একটি ই-বুক এবং আরবি ভাষা শিখতে ‘দ্য কুইক স্টার্ট গাইড টু স্পোকেন অ্যারাবিক’ নামে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় আরেকটি ই-বুক প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন হোটেল, স্টেশন ও দর্শনীয় স্থানগুলোতে রয়েছে এসব ই-বুকের কিউআর কোড। দোহার বিভিন্ন স্থানে সাঁটানো হয়েছে আরবি ও ইংরেজিতে নবী করিম (সা.)-এর হাদিসসংবলিত দেয়ালচিত্র।

আরব ও ইসলামি সংস্কৃতি প্রচারের অংশ হিসেবে রেডিও-টেলিভিশনে ইসলামের নান্দনিক বিষয় নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। ব্যয়বহুল ক্যাফে-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে শপিং মলগুলোতেও ইসলাম প্রচারে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মানুষকে নীতিনৈতিকতা গঠনের জোর আহ্বান জানানো হচ্ছে। দেশটির সৌক ওয়াকিফ বাজারে প্রতিদিন হাজারো ফুটবল অনুরাগী জড়ো হন। সেখানকার একটি অংশে বিনা মূল্যে ইসলামবিষয়ক বই ও পুস্তিকা রাখা আছে। সেখানে একটা জায়গায় লেখা আছে, ‘আপনি যদি সুখের সন্ধান করেন… তবে তা ইসলামেই পাবেন।’

ইসলামের শৈল্পিক উপস্থাপন : ইসলামের শৈল্পিক উপস্থাপনে মুগ্ধ হয়েছেন বিশ্বকাপ দেখতে আসা ভক্ত ও দর্শকরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল এক ভিডিওতে এক ম্যাক্সিকানভক্তের ইসলাম গ্রহণের কথা জানা গেছে। তিনি দোহার কাতার কালচারাল সেন্টারে এসে মুগ্ধতার কথা জানিয়ে কালেমা শাহাদত পাঠ করেন। সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট ও ইসলামিক দায়ি হায়ান আল-ইয়াফায়ি ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে তার ঘটনা বর্ণনা করেন। কালচারাল সেন্টারটি দর্শনার্থীদের জন্য ১২ ঘণ্টা খোলা থাকছে।

হায়ান আল-ইয়াফায়ি বলেন, ‘মেক্সিকোর এক ভক্ত ইসলামি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে স্থানীয় মসজিদ পরিদর্শনে আসেন। আমি তার কাছে ইমানের মূল ভিত্তিগুলো তুলে ধরি। তাকে বলি যে ইসলাম সব নবী-রাসুলের ধর্ম ছিল। মহান আল্লাহ তার পথ প্রদর্শনের জন্য নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন। তাদের মধ্যে হজরত মুসা (আ.), হজরত ঈসা (আ.) ও নবী মুহাম্মদ (সা.)-সহ সবাই একজন রবের উপাসনা করেছেন।’

আল-ইয়াফায়ি আরও জানান, ইসলাম সম্পর্কে সবকিছু জেনে সে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করছেন কি না। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, তাকে কেউ বাধ্য করেনি; বরং স্বেচ্ছায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন।

কানাডীয় দম্পতি ডোরিনেল পোপা ও ক্লারা পোপা। বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে তারা কাতারে রয়েছেন। তারা রুটিন করে দেশটির বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখছেন। ৫৪ বছর বয়সী ডোরিনেল একজন হিসাবরক্ষক। তিনি বলেন, তারা এই প্রথম ইসলাম ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। ডোরিনেল বলেন, ইসলামের সংস্কৃতি ও ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে তাদের ভুল ধারণা আছে। পরিচিতির অভাবের কারণে এমনটা হয়েছে।

ডোরিনেলের স্ত্রী ক্লারা পোপা (৫২) একজন চিকিৎসক। তিনি বলেন, ইসলাম সম্পর্কে তাদের মধ্যে এত দিন যেসব চিন্তাভাবনা ছিল, তা হয়তো এখন পরিবর্তন হবে। কাতারে অবস্থানরত সিরিয়ার স্বেচ্ছাসেবক জিয়াদ ফাতেহ বলেন, বিশ্বকাপ ফুটবল হলো লাখো মানুষকে ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটি সুযোগ। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ‘ভুল’ ধারণা পাল্টে দেওয়ার একটি সুযোগ।

ইসলাম সম্পর্কে জানার সুযোগ : কাতার বিশ্বকাপ দেখতে এসে দর্শকদের ইসলাম সম্পর্কে সঠিকভাবে জ্ঞানলাভের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট কার্টার। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইসলামিক টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। ব্রিটিশ সাংবাদিকের এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। তার এ বক্তব্যকে কাতারসহ আরব ও মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে ভিন্ন চিত্রায়ণ হিসেবে দেখছেন নেটিজেনরা।

কাতারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ইসলাম পরিচিতিমূলক বিভিন্ন আয়োজনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপের ইভেন্টগুলো ইসলামের বাস্তবতা সম্পর্কে জানার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে এবং পশ্চিমাদের ইসলামোফোবিয়া তৈরির পেছনে কারা রয়েছেন তা প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া নামাজের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকাপের ইভেন্টগুলো স্থগিত রাখা হচ্ছে, অন্য রকম অনুভূতি তৈরি করছে দর্শকদের মধ্যে।’

ব্রিটিশ সাংবাদিক আরও জানান, ‘পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম ও মুসলিম সমাজের নানা ইস্যু নিয়ে যুদ্ধ ও সংঘাত এখনো অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো ইউরোপে ইসলামোফোবিয়ার বিস্তার এখনো একটি বড় সমস্যা। অবশ্য বিভিন্ন ইসলামি সংস্থার সহযোগিতায় মিথ্যা অভিযোগ ও তথ্যের খণ্ডন করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বকাপ আয়োজনকে ঘিরে কাতারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। ইসলামফোবিয়ার পদ্ধতিগত প্রচারণার অংশ হিসেবে তা করা হয়। এর মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।’

সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বার্তা : কাতার বিশ্বকাপ ঘিরে দোহা ও আশপাশের শহরগুলো সেজেছে বর্ণিল সাজে। ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের উদ্বোধনী পর্বে পাঠ করা পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত। তাতে মার্কিন অভিনেতা মর্গান ফ্রিম্যান ও কাতারি তরুণ গানিম আল-মিফতাহর এক সংলাপে জাতিগত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া হয়।

স্টেডিয়ামে রয়েছে নামাজের স্থান ও হালাল খাবারের ব্যবস্থা। তা ছাড়া অ্যালকোহল নিষেধাজ্ঞার পর স্টেডিয়ামের মধ্যে এ নিয়ে কোনো বাগবিতণ্ডা শোনা যায় না। তা ছাড়া শহরের রাত্রিকালীন ফ্যান ফেস্টিভ্যাল ইভেন্টে মুসলিমভক্তদের জন্য নামাজের বিরতি দেওয়া হয়। তাই এমন উৎসবগুলো দারুণ উপভোগ করছেন বিভিন্ন দেশের মুসলিমভক্তরাও।

মসজিদে গিয়ে বদলাচ্ছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি : ৯২ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো আরব-মুসলিম দেশে তা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে আরব ও মুসলিম সংস্কৃতিকে জানা ও সরাসরি দেখার সুযোগ মিলছে অনেকের। প্রতিদিন দোহার বিভিন্ন মসজিদে পরিদর্শনে অমুসলিম আসছেন দর্শনার্থীরা। দোহাভিত্তিক সংবাদ দ্য পেনিনসুলা সূত্রে জানা যায়, রাজধানী দোহার কাটরা সাংস্কৃতিক জেলায় অবস্থিত ব্লু বা নীল মসজিদে বিশ্বকাপ উপলক্ষে শিল্প, সংস্কৃতি ও বিনোদনমূলক নানা অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শক মসজিদ প্রাঙ্গণে এসে ভিড় করছেন। বিশ্বকাপের দর্শকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ ও সঠিক উপলব্ধি ছড়িয়ে দিতে ৩০টি ভাষায় কাজ করছেন কাতারের পুরুষ ও নারী স্বেচ্ছাসেবকরা।

মসজিদের পাশেই ‘আসক মি অ্যাবাউট উইম্যান ইন কাতার’ নামে একটি লাউঞ্জ খোলা হয়। এখানে বসে বিদেশি নারী পর্যটকদের জন্য চা পানের সুযোগ রয়েছে। এ সময় তারা আছে ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং কাতারের সামাজিক জীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছেন। আগন্তুতকদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব দিতে স্বেচ্ছাসেবকরা সেখানে কাজ করছেন। স্বেচ্ছাসেবক উম্মে আহমদ জানান, বিদেশি দর্শকদের কাছে ইসলাম ধর্ম ও আরব সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করতেই মসজিদের পাশে এমন আয়োজন করা হয়েছে। তা ছাড়া কাতারের পোশাক, খাদ্য, পানাহারের সংস্কৃতি ও স্থানীয় ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। কাতারের পরিবারের সামাজিক সম্পর্ক ও বৈবাহিক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার আগ্রহ অধিকাংশ পর্যটকের।

তিনি আরও জানান, তাদের সামাজিক প্রশ্নগুলোর বেশির ভাগই ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে একজন মুসলিমের জীবন নিয়ে। অনেক দর্শনার্থী স্বীকার করেছেন যে ইসলাম মুসলিম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক অযৌক্তিক কুসংস্কারে ভরপুর ছিল। কিন্তু কাতারে অবস্থান তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তনে সহায়তা করেছে। মসজিদের প্রবেশমুখে দর্শনার্থীদের কাছে ইসলামের পরিচিতি তুলে ধরছেন কাতারের গেস্ট সেন্টারের দায়িত্বশীল ও ইসলাম প্রচারকরা। অমুসলিম দর্শকদের স্বাগত জানিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন তারা। মসজিদের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে নামাজের পর মসজিদের ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়।

জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ইসলামি পোশাক : কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী ইসলামি পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিশ্বকাপের বিদেশি দর্শকদের মধ্যে। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত দীর্ঘ সাদা জুব্বা ও লাল রুমাল পরে আনন্দে মেতে উঠেছেন অনেকে। স্থানীয় সংস্কৃতি ও পোশাক ধারণ করে জীবনের প্রথম দুর্দান্ত সব অভিজ্ঞতায় মেতে উঠেছেন তারা।

আল জাজিরা সূত্রে জানা যায়, দোহার শত বছরের পুরনো সুক ওয়াকিফ এখন বিশ্বকাপের ফ্যান ও দর্শকদের মিলনক্ষেত্র। সেখানে এসে পছন্দের কাপড় বাছাই করছেন সবাই। দীর্ঘ পোশাকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পছন্দের দেশের পতাকা ও জার্সি। গাতরা নামে পরিচিত রুমাল মাথায় নিয়ে গায়ে জুব্বা পরছেন তারা। এসব পোশাক পরতে সহযোগিতা করছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দলগুলো।

বিশ্বকাপ দেখতে এসে জীবনের প্রথম জুব্বা পরার অভিজ্ঞতার কথা জানান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যান স্টিভ লভেল। নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমার জন্য এমন পোশাক পরার অভিজ্ঞতা সত্যিই দুর্দান্ত। প্রথম দিকে আমার কাছে কিছুটা গরম মনে হলেও মৃদুমন্দ বাতাসে আরামদায়ক হয়ে ওঠে তা।’

বিশ্বকাপ দেখতে এসে জীবনে প্রথমবারের মতো মুসলিম সংস্কৃতির অনুসরণে হিজাব পরার অভিজ্ঞতা হচ্ছে অনেক নারী দর্শকের। হিজাব পরে ভক্তদের আনন্দঘন কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে। ভক্তদের হিজাব পরায় সহযোগিতা করছেন মুসলিম ভলান্টিয়াররা।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION