শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৪৯ অপরাহ্ন
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ:
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষী জনগণের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার দিন। তাদের চক্ষুষ্মান হওয়ার দিন। বাঙালিরা প্রথমে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবিতে সোচ্চার হয় এ উপলব্ধিতে যে ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই নিজের ভাষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি-কৃষ্টিও ঐতেহ্যের বাঞ্ছিত বিকাশ ছাড়া জাতীয় পরিচয় নির্মল ও নিরাপদ নয়। কোনো জাতিকে পরাভূত করার প্রকৃষ্ট কৌশল হলো তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে দুর্বল করা বা তার আত্মমর্যাদাবোধকে খর্ব করা। এ ভারতবর্ষের রাষ্ট্রযন্ত্রে মোগল আমলে ফার্সি, ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি এবং তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস শুরু হয়। আর সেই থেকে বাঙালি জাতির চিন্তা-চেতনায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় চলে আসে। মহান ভাষা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও এর কার্যক্রমের মূল সুর বা বাণী বা দাবিই ছিল বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। কেননা বাংলা ভাষার যথাযথ স্বীকৃতি ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের মৌল উদ্দেশ্যই হবে বাংলাভাষী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন। এটা বাঙালি জাতির জাত্যাভিমানের প্রতি প্রকাশ্য আঘাত। এটা মেনে নেওয়া মানে বাঙালির স্বাধিকার চেতনার মর্মমূলে কুঠারাঘাত এবং প্রকারান্তরে আবহমানকালের সেই পরাধীন পরিবেশে বসবাস। ভাষা আন্দোলনের সৈনিকরা সমগ্র দেশবাসীকে এ সত্যটি উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগ ও ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে মাতৃভাষা, বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা সংগত কারণেই সোচ্চার হয়ে ওঠে। আটচল্লিশের মার্চে জিন্নাহর ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’- এ উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং তাদের প্রচারণা প্রয়াসে পূর্ববঙ্গের সচেতন ছাত্র-শিক্ষক-জনতা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার প্রশ্নে আপসহীন মনোভাব গ্রহণ করে। তাদের দৃঢ়চিত্ত প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা বাহান্নর ফেব্রুয়ারি মাসের দিনগুলোতে বাংলা ভাষা সংগ্রাম উত্তাল আকার ধারণ করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বুলেটের আঘাতে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে ভাষা শহীদরা সেই সংগ্রামী প্রত্যয় ও প্রেরণাকে বেগবান করেছিলেন।
কোনো কোনো বিশেষ ঘটনা, কোনো কোনো আত্মত্যাগ আদর্শগত কারণে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যবহ রূপ লাভ করতে পারে। সেই আত্মত্যাগ যদি হয়ে থাকে মহত্তম কোনো আদর্শের প্রশ্নে, সেই বিশেষ ঘটনায় যদি ঘটে অনির্বাণ আকাক্সক্ষার অয়োময় প্রত্যয়ের প্রতিফলন। স্থান-কাল-পাত্রের সীমানা পেরিয়ে সেই ঘটনা ভিন্নতর প্রেক্ষাপটেও নতুন নতুন চেতনার জন্মদাত্রী হিসেবে প্রতিভাত হয়ে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জীবনে তেমনি এক অসীম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যা আমাদের সার্বিক জাগরণের উৎসমুখও। একুশের চেতনা বারংবার সংকটে দিক-নির্দেশক, বিভ্রান্তিতে মোহজাল ছিন্নকারী এবং আপাত বন্ধ্যত্বে সৃষ্টিমুখরতার দ্যোতক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সাত দশক আগে ১৯৫২-র একুশ ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট নির্মিত হয় তার তাৎক্ষণিক তাৎপর্য মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সীমবদ্ধ ছিল। কিন্তু কালপরিক্রমায় এর তাৎপর্যের পরিধি বিস্তৃত হয়। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে এক নতুন প্রত্যয় ও প্রতীতি দান করে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একুশের চেতনাই ছিল প্রাণশক্তি।
একুশের চেতনা যে সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম দেয় তার মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশমুখী আন্দোলনের একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও ছিল। একুশের চেতনা এমনই প্রগতিশীল ছিল, এমনই প্রগাঢ় ছিল যে যার জন্য স্বাধিকার আদায়ের সংগাম তীব্রতর হয়েছিল। একুশের ভাবধারা প্রথম দিকে ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে তাতে দেশের আপামর জনসাধারণও উদ্বুদ্ধ হয় সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। একুশের মূল্যবোধ যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, স্বৈরাচারের পতনকার্যে একতাবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করতে, নিপীড়িত জনগণের পাশে এসে দাঁড়াতে এবং সর্বোপরি মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে শিক্ষা দেয়। একুশের চেতনা দেশের সাহিত্যাঙ্গনেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জাতীয়তাবোধের উচ্চারণে সমৃদ্ধ সাহিত্যের পাশাপাশি গণমুখী সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন দেশের কবি-সাহিত্যিকরা। সাহিত্যধারায় সূচিত হয় এক নবযুগ।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তাই একুশের চেতনা গোটা জাতির দীর্ঘ পরাধীনতার অভিশাপপ্রসূত দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে আত্মসম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে গঠনমূলক প্রতীতির জন্ম দিয়েছিল। এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই একুশের চেতনার সার্থক স্বীকৃতি। স্বাধীনতার স্পর্শে জাতীয় জীবনে নৈতিকতা, পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, বলিষ্ঠ জাতীয় চরিত্র চেতনার বিকাশ এবং দারিদ্র্য মোচনের দ্বারা স্বনির্ভরশীলতা অর্জনের মধ্যেই একুশের প্রকৃত প্রত্যয় নিহিত।
বাহান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের ব্যানারে চলেছিল মূলত বাঙালির আত্মরক্ষার সংগ্রাম আর স্বাধীনতার লাভের পর তা প্রতিভাত হয় আত্মবুদ্ধি ও চেতনা প্রসারের। আবেগের তীব্রতায় একুশের চেতনা স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে যেভাবে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করেছিল সবাইকে সেখানে মৃত্যুও তুচ্ছ ছিল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে আজ সেই চেতনা আমাদের তা সম্মানসহকারে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায় এবং যার জন্য এখন নিছক আবেগ নয়, সার্বিক উন্নয়ন অভীপ্সায় আজ সুষ্ঠু গাণিতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। সমগ্র ও বিপুলভাবে বাঁচার প্রয়োজনে সমষ্টিগত পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ ও নিরুদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ প্রয়োজন।
একুশের চেতনা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জ্ঞানের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি সম্মানবোধকে জাগিয়ে তুলেছিল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেই মূল্যবোধের বলিষ্ঠ বিকাশ প্রত্যাশিত রয়ে গেছে আজও। তবে সেই মূল্যবোধের বাঞ্ছিত বিকাশের সুযোগ সুদূর পরাহত নয়। একুশের চেতনা কালপরিক্রমায় সেই মনোভঙ্গি ও দূরদৃষ্টিকে করে সবল ও স্বচ্ছ। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বাঞ্ছিত লক্ষ্যে আজ এগিয়ে সবাই। এটি একুশের চেতনার অবিনশ্বর অভিযাত্রা।
দেশের বিপুল জনসমষ্টিকে মানবসম্পদে রূপান্তরের মধ্যেই সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির উপায় নিহিত। স্বনির্ভর অর্থনীতি উৎসারিত আত্মমর্যাদাবোধ জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অন্যতম রক্ষাকবচ। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে মানব সম্পদের উন্নয়ন আবশ্যক। বলিষ্ঠ চরিত্র চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে এটি এক মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। নৈতিকতা, দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদাবোধের ভিত্তি রচনা করে যে সব চরিত্রচেতনা তার বলিষ্ঠ ও বাঞ্ছিত বিকাশ প্রয়োজন। একুশের চেতনা সেই আকাক্সক্ষাকে অর্থবহ রূপদান করতে পারে। ইতিহাসের বিচিত্র পরিক্রমণে কখনো মানুষের নেতৃত্বে যুগের পরিবর্তন ঘটে, কখনো বা ঘটনার নেতৃত্বাধীনে মানুষ পরিবর্তিত মূল্যবোধে সংস্কৃত হয়ে ওঠে। একুশের চেতনা এ মুহূর্তে দেশবাসীকে সেই প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে এবং জাগাতে পারে শক্তি ও সাহস।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতার মৃত্যুতে গভীর ক্ষোভে তার কালো আচকান কাঁচি দিয়ে কেটে তার পোশাকের সঙ্গে সেঁটে শোকের ও প্রতিবাদের ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন। আরও পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, সেই ১৯২৬ সাল থেকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী হবে কিংবা পূর্ববাংলার জনগণের মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি প্রদান নিয়ে তার সমসাময়িক বিজ্ঞজনদের মতো ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও চিন্তিত ছিলেন, যুক্তি ও সক্রিয় সজ্ঞানে সোচ্চার ছিলেন। বাহান্নর বাষা আন্দোলন কোনো একটি সাধারণ বা সাময়িক ঘটনা ছিল না; এর ছিল সুদীর্ঘ এক পটভূমি। তারও আগে আমরা দেখি ১৯১৮ সালে খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ (১৮৭৩-১৯৬৫) বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলার যথার্থ স্বীকৃতি, বিশেষ করে সমকালীন কিছু বিদ্বজ্জনের উর্দুর প্রতি প্রকাশ্য ওকালতির বিরুদ্ধে তিনি আপনার অভিমতকে যুক্তি সহকারে উপস্থাপন করেছিলেন।
বাহান্ন পর্যন্ত একুশ ছিল আত্মত্যাগ-পর্বের প্রস্তুতিপর্ব; আর বাহান্নর পরের একুশগুলো ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্দীপ্ত হওয়ার পথে প্রেরণার উৎস। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পূরণ হলে একুশের আন্দোলন স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত হয়। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও নবজাগরণের প্রতিটি মাইলফলকে ভাষা আন্দোলনের চেতনাই বারবার প্রেরণা, দুরন্ত সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে বাঙালি জাতিকে। এসব প্রয়াস-প্রচেষ্টার পথ ধরেই চূড়ান্তভাবে একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরে মহান বিজয় সূচিত হয়েছে। জন্ম নিয়েছে ভাষার নামে একটি দেশ, ‘বাংলাদেশ’। পৃথিবীতে এমনভাবে কোনো জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একমাত্র ব্যতিক্রম। চীনা জাতির ইতিহাসে ৪ মে যেমন, একুশে ফেব্রুয়ারি তেমন বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার চিন্তচেতনা জাগ্রত হওয়ার দিন।
স্বাধীনতা লাভের পরও একুশ বিভিন্ন সংকট সন্ধিক্ষণে, আপাত বন্ধ্যত্বের কালে জাতিকে জাগ্রত করতে চেতনাদাত্রী হিসেবে কাজ করেছে। একুশের বইমেলা সে ধরনের একটি উপায়-উপলক্ষ যা বাঙালি জাতিকে এক অনবদ্য ঐক্যে সৃজনশীল সাংস্কৃতিক আবহে উদ্বুদ্ধ করে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন এখন আর কোনো একপক্ষীয় দাবি বা কর্মসূচি নয়, বাংলা ভাষা এবং এর সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধকরণ সবার সম্মিলিত প্রয়াস-প্রচেষ্টার প্রতিফলনও। একুশের বাণী জাতিকে স্বয়ম্ভর হতেও উদ্বুদ্ধ করে ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’
লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
mazid.muhammad@gmail.com