শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৫১ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

রোজায় মূল্যবৃদ্ধির ধারা কি চলতেই থাকবে

জুমার দিন, ফাইল ছবি

মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৩ মার্চ বাংলাদেশে পবিত্র রমজান শুরু হতে পারে। দিনের হিসেবে ২৭ দিন পরে হলেও রমজান কিন্তু আমাদের দরজায়, আলোচনায় এমনকি চিন্তায়। এর কারণ বাজার পরিস্থিতি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন মতে, এবারের রোজায় দেশের মানুষকে ছোলা, খেজুর, ভোজ্য তেল, চিনি ও আটার মতো নিত্যপণ্য কিনতে হবে বেশি দামে। অবশ্য নিত্যপণ্যের দাম এখনই গত রোজার চেয়ে অনেক বেশি। সংগত কারণে রোজায় চাহিদা বাড়ে ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, ডাল ও খেজুরের। এর বাইরে চাল ও আটার চাহিদা সব সময়ই থাকে। চাল বাদে বাকি পণ্যগুলোর চাহিদার বেশির ভাগ মেটানো হয় আমদানি করে। পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, এখন পর্যন্ত আমদানি কম। আর এখানেই কারসাজির সুযোগ সৃষ্টি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষের। আসন্ন রমজানে যে পরিস্থিতি সন্তোষজনক থাকবে, এটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।

মহামারী করোনার কারণে বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় আশানুরূপ উন্নতি হয়। করোনা মহামারীতে অনেকে বেকার হয়েছেন, আবার চাকরি থাকলেও আয়-রোজগার কমেছে অনেকের। ফলে, বর্তমান বাজারদর যদি স্থিতিশীলও থাকে, তার পরও সাধারণ মানুষের চলা দায়। এর মধ্যে পবিত্র রমজানে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের জন্য যা হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় উপলক্ষ বা দেশীয় উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমে। উৎসব ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছাড়ের হিড়িক পড়ে যায়। অনেকে বছরভর এ সময়টার জন্যই অপেক্ষা করে। সারা বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখে। ছাড় আর সেলের এ রীতি দুনিয়াজোড়া, ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ! এখানে সব ধরনের উৎসবের আগে পণ্যের দাম বাড়ে।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সারা বছরই ভেজাল মিশিয়ে কিংবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ক্রেতাসাধারণের পকেট কাটেন। রোজার সময় তাদের অপতৎপরতা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাবে তারা মুনাফা শিকারে চরম বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাদের অতি মুনাফালোভী মনোবৃত্তির কারণে রমজানে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।

প্রায় সব মুসলিমরাষ্ট্রে রমজান মাসে পণ্যের দাম কমাতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। রোজাদারদের খুশি করাকে তাদের ইবাদতের অংশ মনে করে। শুধু মুসলিম বিশ্বই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে জিনিসপত্রের দামের বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকে। আমাদের দেশেই শুধু ব্যতিক্রম। রোজা ও ঈদকে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার মৌসুম হিসেবে বেছে নেয়। তাদের এমন মনোভাব থাকে, এক মাসে সারা বছরের ব্যবসা করে ফেলবে। তারাও মুসলমান, আমরাও মুসলমান, বিষয়টা ভাবতেও লজ্জার করে। বলছি না, কিংবা দাবি করছি না, বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কমিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক, আমাদের দাবি ভোক্তাদের পকেট গলায় পাড়া দিয়ে কাটার প্রবণতা বন্ধ হোক।

সরকারের আশ্বাস আর গণমানুষের দাবি উপেক্ষা করে অসাধু ব্যবসায়ীদের ‘আসবে রোজা, বাড়বে দাম’ এমন মনোভাব কোনোভাবেই কাম্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে চালের দাম বেশি, যা কোনোভাবেই কমল না। এতে নিম্ন ও মধ্য আয়ের সংসারে চলছে অস্থিরতা। দেশের পরিস্থিতি এমন যে নিম্নবিত্তের উচ্চদামে পণ্য ক্রয়ের কষ্ট বোঝার বা দেখার কেউ নেই। কোনো কিছুর দাম একবার বাড়লে আর কমে না। পরিবহন খাতের মতোই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সর্বসাধারণ যেন অসহায়।

রোজা এলেই কেন জিনিসপত্রের দাম বাড়বে? এ তো জানা কথাই যে রোজায় কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। এর মধ্যে আছে পেঁয়াজ, ছোলা, ডাল, চিনি, দুধ, তেল, আটা, মুড়ি, খেজুর, আলু, বেগুন, শসা ইত্যাদি। এসব পণ্য কী পরিমাণ লাগবে, তাও আমাদের জানা আছে। আগেভাগেই কেন আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না। নির্দিষ্ট একটি পণ্য দেশে কতটুকু আছে, কতটুকু উৎপাদিত হয়েছে, বাড়তি কতটুকু আমদানি করতে হবে, তার হিসাব কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অবশ্যই থাকতে হবে। প্রতি বছরই তাহলে কেন এ অনিয়ম? এ ধারা কি যুগ যুগ ধরেই চলবে?

প্রশাসন থেকে বলা হয়, পণ্যের ঘাটতি নেই, বিপরীতে আমরা দেখছি দামেরও মাত্রা নেই! অথচ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয়সহ নানা পর্যায়ের মাথাভারী বোঝা রয়েছে; জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে যাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। তাহলে সংশ্লিষ্টজন ব্যক্তিরা কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন?

বাংলাদেশে অনেক দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবার দারিদ্র্যের গ্লানি থেকে বেরোতে পারছে না শুধু নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য ও চিকিৎসাব্যয়ের কারণে। এমন অবস্থায় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়লে গরিবরা সবচেয়ে বেশি চাপে থাকবে। এমনিতেই মানুষ খাবারের তালিকা কাটছাঁট করেছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙেছে এবং ভাঙছে। মানুষ বাজার ও চিকিৎসা খরচ সামলাতে পারছে না। এর মধ্যে রমজানে পণ্যমূল্যের বৃদ্ধির ফলে অনেক মানুষকে না খেয়ে রোজা পালন করতে হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এ কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই, মুনাফা অর্জন ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক নীতি। কিন্তু জনগণকে জিম্মি করে অতি বা অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন ব্যবসার নীতি হতে পারে না। রমজানের অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে সংযম। জীবনের সব ক্ষেত্রে সংযমী হওয়াই রমজানের শিক্ষা। অথচ আমাদের জীবনে এর ব্যতিক্রম বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্টোটা দেখতে পাই। এসবের দ্বারা প্রকারান্তরে ওইসব ব্যবসায়ী রমজানের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেন। কারণ, অহেতুক জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে তারা রোজাদারদেরই কষ্ট দেয়।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বাড়ানো নিশ্চিতভাবেই মিথ্যা ও ঠকবাজির নামান্তর। কাজটি কত গর্হিত, আল্লাহর কত অপছন্দনীয় এবং এর পরিণতি কত ভয়াবহ তা অসাধু ব্যবসায়ীরা চিন্তা করে দেখে না। কোরআন মজিদে আল্লাহপাক অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘চরম দুর্ভোগ তাদের জন্য (বা ওয়াইল নামক দোজখে যেতে হবে তাদের) যারা মাপে কম করে। (আল্লাহপাক আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলছেন) যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয় তখন পূর্ণমাত্রায় নেয়। (নিজের হিসাবটা ঠিকমতো বুঝে নেয়)। যখন লোকদের মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয় তখন কম করে দেয়। (ঠকায়। ব্যবসায়ে প্রতারণা ও ঠকবাজির এই কাজটি কাফেরদের চরিত্রের মতো। আল্লাহপাক জিজ্ঞাসা করেন) তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা (মরণের পর) পুনরায় উত্থিত হবে? যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে। এটা কিছুতেই উচিত নয়। নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জিনে আছে।’সুরা মুতাফফিফিন : ১-৮

আমরা মনে করি, নামাজ না পড়লে, রোজা না রাখলে, হজ না করলে, বা জাকাত না দিলে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। অথচ লক্ষ করুন, ব্যবসায়ে প্রতারণা ও ঠকবাজি করলে পাপী হিসেবে সাব্যস্ত হতে হবে। ওই আয়াতে তাদের পাপী হিসেবে জাহান্নামিদের কাতারে দাঁড় করানো হয়েছে। বিষয়টি ব্যবসায়ীদের অনুধাবন জরুরি।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক

muftianaet@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION