শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:১৯ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ :
সময়ের আবর্তে প্রতিবছর রমজান মাস আসে। এর উদ্দেশ্য হলো রমজানের শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের একজন পরিপূর্ণ মুমিন হিসেবে গড়ে তোলা। তাই মুমিন-মুসলমান হিসেবে সবার উচিত জীবন গঠনে রমজানের শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানো, এগুলো নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করা।
আমরা জানি, ইবাদত বাহ্যিক ও আত্মিক দুধরনের হয়ে থাকে। রোজা একটি আত্মিক ইবাদত, যা সম্পূর্ণরূপে রিয়া তথা লোক দেখানো মুক্ত একটি ইবাদত। একজন মুমিন-মুসলিম বাহ্যিক কোনো নেক আমল করলে মানুষ তা দেখতে পায়, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। কারণ কেউ রোজাদার কিনা তা একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে আল্লাহ রাসুল! আমাকে এমন একটি কাজের আদেশ দিন যার দ্বারা আল্লাহ আমাকে উপকৃত করবেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি রোজা রাখ। রোজার সমতুল্য কিছু নেই।’ সুনানে নাসাঈ : ২৫২৯
শুধু রোজা নয়, মুমিনের প্রতিটি ইবাদতই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন! আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।’ সুরা আনআম : ১৬২
রোজার মতো যেকোনো ইবাদত কবুলের পূর্বশত হলো হালাল খাবার। মানুষের জীবন, কাজ-কর্ম, চরিত্র ও আচরণের ওপর হালাল ও হারাম খাদ্যের প্রভাব পড়ে। তাই হালাল খাবার খেলে ভালো ও নেক কাজের প্রেরণা জাগে। পক্ষান্তরে হারাম খাবার খেলে গোনাহ ও নিষিদ্ধ কাজের প্রেরণা আসে। সে জন্য হালাল খাদ্যগ্রহণের জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র জিনিস থেকে খাবার গ্রহণ করো এবং নেক কাজ করো।’ সুরা আল মুমিনুন : ৫১
বর্ণিত আয়াতে খাবারের সঙ্গে নেক আমলকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। অধিকন্তু হারাম আয়-উপার্জন দিয়ে রোজাসহ কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না বলে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে জানিয়ে দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন এক মুসাফিরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন, ‘যে বহু দূরদূরান্ত থেকে সফর করে এসেছেন এবং যার চুল ধুলামলিন ও এলোকেশি, তিনি আকাশ পানে দুই হাত তুলে দোয়া করেন এবং বলেন, হে রব! হে রব! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারামের ওপর ভিত্তি করেই তিনি গড়ে উঠেছেন, তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ সহিহ মুসলিম : ২২১৮
রমজানের রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আত্মসংযম। একজন মানুষ আত্মসংযমের চর্চা করে তখন নৈতিকতাবিবর্জিত সব কাজ থেকে সংযত থাকারও চর্চা করে। যথাযথভাবে রোজা পালনে একজন মুমিন বান্দার মাঝে চারিত্রিক ত্রুটিমুক্ত হয়ে উন্নত নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্র গড়ে ওঠে। হাদিসে এসেছে, হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যখন তুমি রোজা রাখবে তখন যেন তোমার কর্ণ, চক্ষু এবং জিহ্বাও মিথ্যা ও হারাম কাজ থেকে রোজা রাখে। তুমি প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাক। আত্মমর্যাদা ও প্রশান্তভাব যেন তোমার ওপর বজায় থাকে, এমন হলে তোমার রোজা রাখা ও না রাখা সমান হবে না।’ ইবনে আবি শাইবা : ৮৮৮০
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আমাকে তার দুই ঠোঁট ও দুই ঊরুর মধ্যবর্তী স্থানের নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।’ সহিহ বোখারি : ৬১০৯
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে রোজাদারদের ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের নির্দেশনা দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সিয়াম ঢালস্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কাজ করবে না। যদি কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুইবার বলে, আমি সিয়াম পালন করছি।’ সহিহ বোখারি : ১৭৭০
পবিত্র রমজান মাসে আমাদের সামনে সব ধরনের সুযোগ থাকার পরও আমরা পানাহার বর্জন করে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে থাকি। তাই এই রমজান মাসকে শাহুরুস্ সবর তথা ধৈর্যের মাস বলে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই রোজাসহ আল্লাহর প্রতিটি হুকুম আমাদের ইচ্ছা হোক বা না হোক তা পালনে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে যেতে হবে।
মনে রাখা দরকার, শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় চলাচল করে আমাদের কুমন্ত্রণা দেয় এবং নফসের কুপ্রবৃত্তির কারণে আমরা অনেক পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ি। রমজানের সিয়ামের মাধ্যমে আমরা শয়তান ও কুপ্রবৃত্তি দমনের শক্তি অর্জন করে থাকি। তাই কুপ্রবৃত্তি দমনেও সিয়াম পালনের নির্দেশনা এসেছে হাদিসে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা যুবক বয়সে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম, অথচ আমাদের কোনো কিছু (সম্পদ) ছিল না। এমনি অবস্থায় আমাদের রাসুল (সা.) বলেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষাকবচ।’ সহিহ বোখারি : ৪৬৯৬
আরেকটি কথা, রমজানের রোজা কি গোনাহ মাফের উপযুক্ত করে তুলছে কিনা তা নিয়ে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনা করতে হবে। এমন রোজাদারের জন্যই গোনাহ মাফের ঘোষণা রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ইমান (বিশ্বাস) ও ইহতেসাবের (একনিষ্ঠ নিয়ত, প্রত্যাশা) সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে রমজানের রোজা রাখবে আল্লাহতায়ালা তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ জামে তিরমিজি : ৬৮০
আল্লাহতায়ালা সবাইকে পরিপূর্ণ হক আদায় করে রমজানের রোজা পালনের তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com