রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪২ অপরাহ্ন
শায়খ ড. আবদুল বারী বিন আওয়ায আস সুবাইতি:
পবিত্র রমজান মাসের শেষ ভাগ খুবই নিকটবর্তী। নেককার মুমিনদের হৃদয় শেষ দশ দিনের ফজিলত লাভের জন্য উন্মুখ থাকে। নিজের যাবতীয় দুর্বলতা, ত্রুটি, উদাসীনতা, পাপাচার এবং শিথিলতার কথা মনে করে জ্ঞানীরা আসন্ন দিনগুলোর যথার্থ মূল্যায়নে মনোযোগী হয়। সমাজে এমন মানুষ আছেন, যে রমজানের শেষভাগের প্রতিটি মুহূর্তকে গণিমত, প্রতিটি ক্ষণকে ফজিলত হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাসবিহ-তাহলিল, প্রশংসা, আল্লাহর বড়ত্ব, নামাজ, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত ও ইসলাম নিয়ে গবেষণার মতো ইবাদতের নেয়ামতে বিচরণ করতে থাকে। তারা রমজানের শেষ দশ দিনের গুরুত্ব অনুধাবন করেছে, ওই দিনগুলোর ফজিলত লাভের আশায় ইবাদতের মাধ্যমে নিজেদের সময়কে অতিবাহিত করে। ওই সময় রয়েছে ইবাদতের স্বর্গীয় স্বাদ, সান্নিধ্য লাভের প্রসন্নতা, তেলাওয়াতের সৌন্দর্য, ইমানের স্বাদ এবং রহমানের উপহার।
রমজানের শেষ দশ দিনের মুহূর্তগুলো খুবই সীমিত, সময়গুলো দ্রুতবেগে চলমান এবং দিনগুলো অতিবাহিত হয় চোখের পলকে। জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ প্রাণবন্ত হিম্মত, সর্বোচ্চ সচেতনতার মাধ্যমে এবং দুনিয়ার কর্মব্যস্ততা ও ধ্যান-জ্ঞান থেকে নিজেদের মুক্ত করে এই দিনগুলোতে ইবাদত পালনে প্রচেষ্টা করে। হজরত আয়েশা (রা.) রমজান মাসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থা বর্ণনা করেছেন আলঙ্কারিক শব্দে ও সংক্ষিপ্ত বাক্যে। যা মূল উদ্দেশ্যকে অবহিত করে। তিনি বলেছেন, ‘যখন রমজানের শেষ অংশ আসত তখন নবী কারিম (সা.) তার লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতির লক্ষ্যে) এবং রাত জাগতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’ সহিহ বোখারি
এ নীতিটি উম্মতের জন্য আলোকবর্তিকা, তওবাকারীদের জন্য পথনির্দেশনা, ইবাদতকারীদের জন্য অনুসৃত পথ, পাপীদের জন্য আশ্রয়স্থল এবং মুমিনদের জন্য উন্নতির উপলক্ষ হয়। রমজানের শেষভাগের রাতগুলোতে বান্দা তার মনিব ও মাওলার সঙ্গে একান্তে মিলিত হয়, তার দুঃখ-বেদনা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করে, তার অভিযোগ জানায়, মহান স্রষ্টার কাছে আশা-আকাক্সক্ষা পেশ করে, স্বীয় পাপের কথা ও ভুল স্বীকার করে, তওবার ঘোষণা দেয়, অনবরত অশ্রু ঝরায়, তার অন্তরকে ভয়ে ও আশায়, অপমান ও ভগ্নতায় পরিপূর্ণ করে রাখে এবং বিনীতভাবে ও গোপনে ডাকতে থাকে। তখন দোয়া কবুল করা হয়, রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হয়। আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো রব নেই এবং তিনি ব্যতীত ঘাটতি পূরণেরও কেউ নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই।’ বাকারা : ১৮৬
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা অত্যধিক লজ্জাশীল ও দাতা। যখন কোনো ব্যক্তি তার নিকট দুই হাত তুলে প্রার্থনা করে তখন তিনি তার হাত দুই খানা শূন্য ও বঞ্চিত ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।’ সুনানে তিরমিজি
অতএব, নিজেকে ক্রয় করুন বাজার চলমান ও মূল্য বিদ্যমান থাকাবস্থায়। কোনো অবস্থাতেই কালক্ষেপণমূলক কথায় কর্ণপাত করবেন না। রমজানের শেষ দশ দিনের অমূল্য দান মহিমান্বিত কদরের রজনীর বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি একে (কোরআন) নাজিল করেছি শবেকদরে। শবেকদর সমন্ধে আপনি কী জানেন? শবেকদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ সুরা কদর : ০৩-০৫
রোজাপালনকারী কি কল্পনা করতে পারে প্রতিদানের বিশালতার বিষয়টি! হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম! আল্লাহর সামনে নামাজে দণ্ডায়মান ব্যক্তি কী কল্পনা করতে পারে এ গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃশ্য এবং বিশাল সমাবেশ! এ রাতের মর্যাদার কারণে ফেরেশতারা এবং হজরত জিবরাইল (আ.) অবতরণ করেন। যে অবতরণ শান্তি, নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে ধারণ করে, বরং সালাম শব্দের সব অর্থকেই ধারণ করে। রাতের পুরোটাই কল্যাণময় এবং তাতে কোনো অকল্যাণ নেই এবং তাতে ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত প্রভূত কল্যাণ অবতরণের ফলে সব ধরনের অনিষ্ট ও বিপদাপদ থেকে মুক্ত। আর ফেরেশতাগণ মসজিদে ইবাদতকারীদের ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সালাম প্রদান করতে থাকে। কদরের রাতটি মনোরম রাত, যা অতি গরম নয়, শীতলও নয়। রাতটির শুরু থেকে ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সম্পূর্ণটাই বরকতময় ও কল্যাণময়। এ রাত আল্লাহর অলি এবং ইবাদতকারীদের জন্য শান্তিময়। এ রাত অবিরত শান্তি ও স্থায়ী নিরাপত্তার চাদরে শামিল করে ওই সব মুমিন ব্যক্তিকে, যারা ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদতে জেগে থাকে। আর এ মহান ফজিলত ও বৃহৎ প্রতিদান অর্জন সম্ভব নয় ইবাদতে কঠোর প্রচেষ্টা, অবিরত আমল, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে প্রিয় জিনিস পরিহার করা ব্যতীত।
রমজানের শেষ ভাগ তো শুধু গুটিকয়েক দিন, অতঃপর ফল আহরণের সময়। বান্দা তার রবের শোকরিয়া জ্ঞাপন করবে এ জন্য যে, তিনি তাকে এই গণিমত লাভ, সওয়াব বৃদ্ধি ও বরকত হাসিলের জন্য মানুষের মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের নিকট এ মাস উপস্থিত। এতে রয়েছে এমন এক রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ থেকে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হলো সে সমস্ত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর কেবল বঞ্চিত ব্যক্তিরাই তার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।’ সুনানে ইবনে মাজাহ
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) নবী কারিম (সা.)কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি যদি কদরের রাত পেয়ে যাই তবে সে রাতে আমি কী দোয়া পড়ব? তিনি বলেন, তুমি বলবে, হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাকারী, তুমি ক্ষমা করতেই ভালোবাস। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।’ সুনানে তিরমিজি
আল্লাহতায়ালা ক্ষমাকারী এবং তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। তিনি সর্বদা ক্ষমাশীলতার গুণে পরিচিত এবং বান্দাদের গোনাহ মাফের গুণে গুণান্বিত। ক্ষমার অর্থ পাপমোচন করা, ভুলগুলো উপেক্ষা করা, অপরাধগুলো গোপন করা ও নিশ্চিহ্ন করা, প্রতিদান বৃদ্ধি করা বরং গোনাহগুলোকে নেকিতে পরিবর্তন করে দেওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে যে তওবা করে, ইমান আনে ও সৎকাজ করে, ফলে আল্লাহ তাদের গোনাহগুলো নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ সুরা আল ফুরকান : ৭০
দয়াময় আল্লাহর ক্ষমাশীলতার পূর্ণাঙ্গ দিক হলো বান্দা নিজের ওপর যতই অবিচার করুক, সে যদি আল্লাহর নিকট তওবা করে এবং পাপাচার থেকে ফিরে আসে তিনি তার সব অপরাধ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ সুরা আয যুমার : ৫৩
সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহর রহমত কতই না বিস্তৃত! তার ক্ষমা কতই না সুন্দর এবং তার অনুগ্রহ কতই না বড়! আল্লাহতায়ালা ওই ব্যক্তির আশাকে ব্যর্থ করে দেন না, যে তার অভিমুখী হয় ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের প্রত্যাশায়। তিনি কখনো সৎআমলকারীর প্রতিদানকে বিনষ্ট করেন না। তিনি পরম স্নেহপরায়ণ, অতিশয় দয়ালু এবং অপরিসীম ক্ষমার অধিকারী। তার রহমত সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা তো এমন সম্প্রদায় যাদের সঙ্গীরা দুর্ভাগা হয় না।’ কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনিই তার বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও পাপসমূহ মোচন করেন এবং তোমরা যা করো তিনি তা জানেন।’ সুরা আশ শুরা : ২৫
৭ এপ্রিল মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা।/অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
ভয়েস/আআ