সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০২:০৭ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
মধ্যরাতে সাংবাদিক আটক ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন ঘুমিয়ে ছিলেন। মোবাইল ফোনে আসা ‘মিসড’ কল নম্বরে পরের দিন সকালে ফোন দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিবের কাছ থেকে প্রথম ঘটনা শুনেছেন। বিভাগীয় মামলার অভিযোগের জবাবে সুলতানা পারভীন এমনটাই দাবি করেছেন। অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও অনুমান-নির্ভর দাবি করে মামলা থেকে অব্যাহতিও চেয়েছেন গত ২৫ জুন দেওয়া অভিযোগের জবাবে।
এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সুলতানা পারভীনসহ চারজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে। তাদের মধ্যে এর আগে সহকারী কমিশনার ও মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এনডিসি এস এম রাহাতুল ইসলাম বিভাগীয় মামলায় আনা অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। এদিকে আরডিসি নাজিম উদ্দিনের সম্পদের হিসাব চেয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সাজা দেওয়ার ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও অনুমান-নির্ভর বলে দাবি করেছেন। একইসঙ্গে মোবাইল কোর্টের অভিযানকে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
গত ১৪ মার্চ কুড়িগ্রামে মধ্যরাতে বাংলাট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামের বাড়িতে ঢুকে তাকে ধরে নিয়ে জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট এক বছরের কারাদন্ড দেয়। তার বাড়িতে আধা বোতল মদ এবং গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এভাবে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এ ঘটনা ফলাও করে প্রচার হলে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। ডিসি সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও ২ সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস এম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিভাগীয় মামলা করা হয়। সেই মামলায় আনা অভিযোগের জবাব দিয়েছেন সুলতানা পারভীন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বিভাগীয় মামলায় সুলতানা পারভীনের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এর জবাবে তিনি বলেছেন, পত্রিকাগুলো কীসের ভিত্তিতে এ অভিযোগ করেছে তা তার বোধগম্য না। জানিয়েছেন, তিনি কোনো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেননি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা দেননি। এ বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে জেলা প্রশাসক নিজে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন না। প্রতি মাসে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশনা থাকায় মাসের শুরুতে ডিসি অফিসে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কোর্ট পরিচালনার সিডিউল প্রস্তুত করে তাতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ওই সিডিউলের বাইরে অন্য কোনো তারিখে কোর্ট পরিচালনা করতে হলে তা অবশ্যই অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করতে হয়। ওই দিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে তার কোনো কথা হয়নি। ঘটনার পরে তিনি নথি তলব করে জেনেছেন প্রসিকিউশন পক্ষ ছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। একজন অফিসারসহ ৬ জন পুলিশ ও ৪ জন ব্যাটালিয়ন আনসার কোর্ট পরিচালনার সময় ছিলেন।
উল্লেখ্য, ডিসি হচ্ছেন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তারা জেলা পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাজ সমন্বয় করেন। এছাড়া জেলার সাধারণ প্রশাসনিক কার্যক্রম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং কালেক্টর হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনা তদারকি করেন। একইসঙ্গে তারা সরকারের বিশেষ কর্মসূচি এবং চলমান উন্নয়নমূলক কাজ দেখভাল করেন। স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ পদে সাধারণত চৌকস অফিসারদের বাছাই করা হয়।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার তদন্ত করেছেন এবং যথেচ্ছভাবে আদালত পরিচালিত হওয়ায় প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার অভিযোগ আনা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে, যা বিভাগীয় মামলায়ও বহাল রাখা হয়েছে।
সাবেক এ ডিসি জানান, ঘটনার দিন সকাল থেকে তিনি রৌমারী উপজেলায় জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সভায় ব্যস্ত ছিলেন। সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, জেলা ও দায়রা জজসহ বিচার বিভাগের কর্মকর্তা, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় অংশ নেওয়ার জন্য তিনি ভোর ৫টায় রওনা হন। সভা শেষে ফিরে আসেন রাত সাড়ে ৯টায়। ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত থাকায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ঘুম থেকে উঠে মোবাইল ফোনে দেখতে পান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিবের এবং ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনারের ‘মিসড’ কল। কল ব্যাক করে তিনি এ ঘটনা অবগত হন। মোবাইল কোর্টের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে এ বিষয়ে তার কোনো কথা হয়নি। এই অবস্থায় মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হওয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার বা প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার দায় কোনোভাবেই তার ওপর বর্তায় না বলে তিনি মনে করেন।
ডিসি অফিসে নিয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইলামের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, মোবাইল কোর্টের নির্ধারিত আইন আছে। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আইন, বিধি ও পদ্ধতি অনুযায়ী কোর্ট পরিচালনা করেন। তারা স্বাধীনভাবে বিচার করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। মোবাইল কোর্টে গিয়ে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট কোন পরিস্থিতিতে কার সঙ্গে কী আচরণ করবেন তা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনা অনুযায়ী হয় না। তার জ্ঞানের অগোচরে সংঘটিত কোনো বিষয়ের দায় কখনো তার ওপর বর্তায় না বলে তিনি বিভাগীয় মামলার অভিযোগনামার জবাবে জানিয়েছেন।
সাংবাদিককে আটক করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করায় অভিযান সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এই অভিযোগের জবাবে তিনি বলেছেন, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অভিযানে গিয়ে কী করেছেন তা তার সঙ্গে সম্পৃক্ত না। মোবাইল কোর্টে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিষয়টি তাকে জানানো প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন তিনি।
গভীর রাতে যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া অভিযান পরিচালনা বিধিসম্মত হয়নি এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি এ দায় এড়াতে পারেন না। এই অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেছেন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে তার সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্টেটের কোনো আলোচনা হয়নি। কাজেই এ অভিযোগ তার জন্য প্রযোজ্য নয়।
সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ আনা হলে তিনি এ অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তিনি নির্দোষ দাবি করে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অন্য কোনো শাস্তির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।
১৯ বছরের সরকারি চাকরি জীবনের পুরোটাই মাঠে কাজ করেছেন সুলতানা পারভীন। মাঝের এক বছর যুক্তরাজ্যে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স করেছেন। ১৬টি নদীবেষ্টিত, বন্যা, নদীভাঙন কবলিত আর্থ-সামাজিক দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া কুড়িগ্রাম জেলার উন্নয়নের জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বলে জানান তিনি। বিভাগীয় পর্যায়ে পরপর দুই বছর তিনি শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের মোবাইল কোর্ট সংক্রান্ত ‘বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনাকে’ কেন্দ্র করে তাকে ‘দুঃখজনকভাবে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি’ হতে হয়েছে মনে করেন সুলতানা পারভীন।
তিনি ২০১৮ সালের ৩ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত দুই বছর কুড়িগ্রামের ডিসি ছিলেন। বর্তমানে পরবর্তী পদায়নের জন্য তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত রয়েছেন।
সুত্র: দেশরূপান্তর।