রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৯ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

হুদায়বিয়ার সন্ধির শিক্ষা

শায়খ ড. আহমাদ বিন আলী আল হুজাইফি:
সৃষ্টির সর্দার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাত (জীবনালেখ্য) এক সৌরভময় বাগিচা। মুমিন-মুসলমানদের উচিত সকাল-সন্ধ্যায় সেখান থেকে ফল আহরণ, এর ঝর্ণাধারা থেকে তৃষ্ণা নিবারণ, এর ছয়াতলে আশ্রয় গ্রহণ এবং এর অভ্যন্তরে বিচরণ করা। জিলকদ মাসের এই দিনগুলোতে নবী কারিম (সা.) উমরাপালনের উদ্দেশে বায়তুল্লাহ জিয়ারতের মনস্থির করেন একটি সত্য স্বপ্নের পরিপ্রেক্ষিতে। আর নবীদের স্বপ্নও অহির অন্তর্ভুক্ত।

হিজরতের ছয় বছর পর রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায় চৌদ্দশত সাহাবি নিয়ে জিলকদ মাসের শুরুতে বের হন। গন্তব্য পবিত্র কাবা। সফরের সরঞ্জাম ছাড়া তিনি ও তার সঙ্গীদের কারও কাছে নেই অস্ত্রশস্ত্র। কাফেলাটি জুল হুলায়ফা (বর্তমানে এর নাম আবয়ারে আলী) নামক স্থানে উপস্থিত হলে তিনি উমরার ইহরাম বাঁধলেন এবং কোরবানির পশুর গলায় মালা পরালেন ও বিশেষ দাগ দিলেন; যাতে কেউ দেখামাত্র বুঝতে পারে, এ কাফেলা যুদ্ধবাজ নয়, বায়তুল্লাহর যাত্রী। কাফেলা চলতে চলতে যখন হুদায়বিয়ার সন্নিকটে পৌঁছলেন, তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছওয়া নামক উষ্ট্রিটি বসে পড়ল। কিছু মানুষ বলতে লাগল, কাছওয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘কাছওয়া ক্লান্ত হয়নি এবং এটা তার স্বভাবও নয়। বরং তাকে তিনিই আটকেছেন যিনি হস্তি বাহিনীকে আটকেছিলেন। সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! কোরাইশরা আমার কাছে যে পরিকল্পনা চাইবে যাতে তারা আল্লাহর সম্মানিত বিষয়সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, আমি তাদের সেই প্রস্তাবই দেব।’ তারপর তিনি উষ্ট্রিকে ধমক দিলে তা উঠে দাঁড়াল এবং তারা রওনা দিয়ে হুদায়বিয়ার শেষ প্রান্তে অবতরণ করলেন।

ইতিমধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে খবর আসে, মক্কাবাসীরা তাকে বায়তুল্লাহর জিয়ারতে বাধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমরা তো কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি, উমরাপালন করতে এসেছি।’ তবুও তারা তাকে মক্কায় প্রবেশে অনুমতি দিতে অস্বীকার করল।

আরবের মানুষ যেন বলতে না পারে, মুহাম্মদ (সা.) জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করেছেন তাই বারবার যোগাযোগ ও দেন-দরবারের পর উভয়পক্ষ এ সন্ধিচুক্তিতে সম্মত হলো যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সঙ্গীরা এ বছর ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর মক্কায় আসবেন। সেখানে তারা তিন দিন অবস্থান করবেন, এ সময় তারা তাদের সঙ্গে সফরের সরঞ্জামাদি ছাড়া কোনো অস্ত্র বহন করতে পারবেন না। মক্কাবাসীদের দাবির অনুপাতেই সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হয়। বিষয়টি কয়েকজন সাহাবির কাছে খুবই কষ্টকর মনে হয়, তাদের বায়তুল্লাহতে যেতে বাধাগ্রস্ত করার কারণে এবং সন্ধিচুক্তির ধারাগুলোতে পক্ষপাতমূলক শর্ত থাকায়।

হুদায়বিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ওই পরিপ্রেক্ষিতে সুরা আল ফাতেহ নাজিল হয় এবং সুরাটি অদ্ভুত গাম্ভীর্যতার সঙ্গে আল্লাহতায়ালা সূচনা করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়, যেন আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করেন এবং আপনার প্রতি তার অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। আর আপনাকে সরল পথের হেদায়েত দেন এবং আল্লাহ আপনাকে বলিষ্ঠ সাহায্য দান করেন। তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাজিল করেছেন যেন তারা তাদের ইমানের সঙ্গে ইমান বাড়িয়ে নেয়। আর আসমানসমূহ ও জমিনের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞ, হিকমতওয়ালা।’

এটা নবী কারিম (সা.)-এর জীবনের একটি ঘটনা, তার উজ্জ্বল দিনগুলোর মধ্য থেকে একটি কাহিনি; যার প্রতিটি বাঁকে রয়েছে এমন উপদেশ ও শিক্ষা যা বহনে কাগজের শুভ্রপাতা সক্ষম নয়। এগুলো তার নিদর্শনাবলির প্রতি নজর বুলাতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এ ঘটনাবলির রহস্য থেকে উপদেশ গ্রহণকে আবশ্যিক করে। এ সব শিক্ষা ও উপদেশমালার অন্যতম হলো

কখনো বাহ্যিক কিছুর প্রতি অন্তর ঝুঁকে পড়ে, অথচ আল্লাহ মুমিনের জন্য এমন ফায়সালা রাখেন; যার পরিণতি প্রশংসনীয় হয়। বাহ্যিকভাবে এ চুক্তিতে যা রয়েছে অন্তরসমূহ তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়, তবুও মহান আল্লাহ এ সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় নামে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা যখন কেউ এই সন্ধির বাহ্যিক বিষয়ের ফল কোনো দিকে যায় তার প্রতি বিবেচনার দৃষ্টিতে তাকাবে এবং এর পরিণতির দিকে দৃষ্টি দেবে ও এর চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে তাকাবে; তখন কোরআন মাজিদে মহান রবের বাণীর সত্যতা তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।’ সুরা আন নিসা : ১৯

বারা বিন আযেব (রা.) বলেন, ‘মক্কা বিজয়কে তোমরা বিজয় মনে করছ। মক্কা বিজয়ও একটি বিজয়, তবে হুদায়বিয়ার দিনের বায়াতে রিজওয়ানকে আমরা প্রকৃত বিজয় মনে করি।’ সহিহ বোখারি

ইমাম যুহরি (রহ.) বলেন, ‘ইসলামের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় বিজয় আগে কখনো অর্জিত হয়নি যখন চুক্তিসম্পন্ন হলো, যুদ্ধের দামামা থেমে গেল আর মানুষজন নিরাপদ হলো, মানুষ একে অপরের সঙ্গে বাক্য বিনিময় করল, তারা সাক্ষাতে পরস্পরে আলাপ আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক করল। বুঝমান যারাই ইসলামের বিষয়ে কথা বলেছে, তারাই ইসলামে প্রবেশ করেছে। ইতিপূর্বে যতসংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল তার চেয়ে অধিক মানুষ এই দুই বছরে (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম হিজরি পর্যন্ত) ইসলাম গ্রহণ করেছে।’

এই সন্ধিচুক্তিটি ছিল আল্লাহর হিকমতের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়তের সুস্পষ্ট আলামত। সন্ধির সূচনা ও সমাপ্তিতে ছিল বিস্ময়কর কিছু বিষয়, সাহাবিদের পরামর্শের বিপরীতে রাসুল (সা.) সন্ধি তৎপরতা চালিয়ে যান এবং উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য তাদের কাছে উপস্থাপন করেন আল্লাহর এ আদেশটি পালনার্থে ও উম্মতের জন্য এ রীতি প্রচলনের জন্য, ‘কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন এবং কাজেকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।’ সুরা আলে ইমরান : ১৫৯

কিন্তু এবারের ঘটনায় আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্ধিটি বহাল রাখার আদেশ সংবলিত অহি তার কাছে নাজিল হয়। ফলশ্রুতিতে এর শুভ পরিণামের পাল্লা রাসুল (সা.) ও তার মুসলিম সঙ্গীদের অনুকূলে উদ্ভাসিত হয় যা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।

আর এতে উপযুক্ত শিক্ষা রয়েছে তার জন্য, যে বিশুদ্ধ প্রমাণিত অহির বিরোধিতা করে যখন তার জ্ঞান অহির উদ্দেশ অনুধাবন করতে ও মর্ম বুঝতে অক্ষম হয়। এ থেকে সে বুঝতে পারে, মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাস্তবিক অর্থে জ্ঞানী সে নয়, যে প্রমাণিত হাদিস ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অস্বীকার করে। এর ওপর ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারীই কেবল নিজেকে হেয়জ্ঞান করে ও নিজের অজ্ঞতা ডেকে আনে যেহেতু জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞজনদের কাছে এটা স্বীকৃত ও গৃহীত বিষয় যে, বিশুদ্ধ দলিল কখনো সঠিক বিবেকের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় না।

আরেকটি শিক্ষা হলো ইসলাম দয়া ও শান্তির ধর্ম। ইসলামি শরিয়ত পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহিষ্ণুতার। তেমনিভাবে এটা আমানতদারিতা, প্রতিশ্রুতি পূরণ ও চুক্তি রক্ষার ধর্ম। কেননা নবী কারিম (সা.) রক্তপাত এড়াতে ও শান্তি স্থাপনের স্বার্থে সন্ধি মেনে নিতে দ্বিধা করেননি, যদিও তাতে পক্ষপাতমূলক শর্ত ছিল। অনুরূপভাবে তিনি সন্ধির শর্ত অনুযায়ী তাদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন।

হুদায়বিয়ার ঘটনার অন্যতম শিক্ষা হলো আল্লাহ যখন সংবাদ দিলেন যে, তিনি তার রাসুলের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করবেন, তখন তিনি রাসুল (সা.) ও তার সাহাবিদের মসজিদে হারামে নিরাপদে প্রবেশের শপথ করলেন। তারপর সবদিক থেকে তারা আতঙ্কমুক্ত বলে সেটাকে আরও জোর দিলেন। কাজেই তাদের অন্তরে কোনো ভয় প্রবেশ করবে না। সুরা আল ফাতহ-এর শেষ দিকে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তার রাসুলকে স্বপ্নটি যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে মাথা মুণ্ডন করে এবং চুল ছেঁটে, নির্ভয়ে। অতঃপর আল্লাহ জেনেছেন যা তোমরা জানতে না। সুতরাং এ ছাড়াও তিনি তোমাদের দিয়েছেন এক সদ্য বিজয়।’

বর্ণিত আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, তারা নিরাপত্তাজনিত বিশাল নেয়ামত লাভ করবেন ওই মহাক্ষণে ও ঘটনার দিনে যা ইসলামের মহত্ব এবং তার উন্নত মূলনীতি ও ভিত্তির চিত্র অঙ্কন করে। সেটা এমন দিনে যে দিনটি মুসলমানদের সম্মেলনের দিন; যেদিন তাওহিদের ঘোষণা ও একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সবার দেহমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাকার হবে। যাতে মানুষের সব ভেদাভেদ চুরমার ও বিলীন হয়, আর ইমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতেই তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয়।

২৬ মে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা।

অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION