শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৩৭ পূর্বাহ্ন
উম্মুল ওয়ারা সুইটি:
জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেও গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচন হয়ে গেল। সেটি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। হাটে মাঠে ঘাটে এখন শুধুই আজমত উল্লা ও আওয়ামী লীগ এবং বিজিত জায়েদা খাতুনের চুলচেরা বিশ্লেষণ। একটি পক্ষ ঘুমহীনভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, শুধু আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার কারণে আজমত উল্লার মতো প্রবীণ রাজনীতিক হেরে গেছেন। বিএনপি নেতারা এই নির্বাচনে মোটামুটি একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। দলটির নেতাকর্মী, সমর্থকদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে জায়েদা খাতুন বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী শিবিরের বাইরের পক্ষটি মনে করেছে জায়েদা খাতুন জয়ী হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির কারণে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন এখন জাতীয় নির্বাচনের একটা অ্যাসিড টেস্টে পরিণত হয়েছে। একটি পক্ষ ধারণাই করছে গাজীপুরের মতো নির্বাচন হলে সবকটিতে আওয়ামী লীগ হারবে। আর আরেকটি পক্ষ মনে করছে, গাজীপুর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের একটি মহড়া হয়ে গেল। আবার এখানে সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিজেদের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট যোগ্য ও সামর্থ্যবান মনে করছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও এর ফলাফল কার পক্ষে গেল এমন বিতর্ক জমে উঠেছে। আমার মনে হয় গাজীপুর নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং এর ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষেই গেল।
প্রথমত, হাবিবুল আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলো নতুন কমিশনকে মেনে নেয়নি। বারবার বলা হচ্ছে এই কমিশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট এবং তাদের অধীনে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন সম্ভব নয়। আর এই দাবিতে আন্তর্জাতিক মহলেও তারা আলাপ-আলোচনা করছে। এখানে আওয়ামী লীগ জিতেছে। কারণ, গত বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের যে নির্বাচনটি হলো আমরা দেখলাম, বিএনপি এবং বিরোধী পক্ষগুলোসহ সব রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অন্যান্য মহল বলছে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও যোগ্যতা প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, নিকট অতীতে নির্বাচনী ফল নিজেদের পক্ষে আনার যে অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে করে আসছিল গাজীপুরে জায়েদা খাতুন জয়ী হওয়ায় সেটির অবসান হবে আশা করি।
গাজীপুর নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া এবং এর ফলাফলের মধ্য দিয়ে সরকার আন্তর্জাতিকভাবেও জয়ী হয়েছে। কারণ দেশের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মন্তব্য এবং বাংলাদেশের নির্বাচনে বিদেশি প্রভাবশালী মহলের কাছে দেন দরবার একটি নিত্য বিষয় হয়ে গেছে। এটি বাংলাদেশের আরেকটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকেই বিএনপি এবং বিরোধী পক্ষের কিছু দল নির্বাচনের পদ্ধতি, নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা এনে বিদেশিদের কাছে নালিশ অব্যাহত রাখছে। দেশের নির্বাচনে বাইরের প্রভাব তৈরির চেষ্টা করে আসছে। ফলে গত কয়েকটি নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মহলের পরামর্শ এবং কখনো কখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে। আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায়। আর আসন্ন নির্বাচনে দলটি যদি আবারও ক্ষমতায় যায় তাহলে চতুর্থবারের মতো হবে। দীর্ঘ ১৫ বছর বিএনপিসহ অন্য ছোট-বড় রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি জোরালো না হওয়ায় তাদের নেতাকর্মীরা অনেকটাই সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে। জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়েই বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো মাঠের রাজনীতির চাঙ্গা করতে পারছে না। যার ফলে তারা মাঠ গোছাতে এবং দলীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে।
অন্যদিকে, টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকার কারণে মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগেরও অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট হয়েছে। পাশাপাশি দলের নেতৃত্বে সংখ্যাও বেড়েছে। ফলে বিগত দু-তিন বছরে যেসব স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে সবকটিতেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর আধিক্য দেখা গেছে। বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লড়াই হয়েছে। সেই লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হেরেছে। সংসদ নির্বাচনেও আলামত পাওয়া যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি আসন থেকেই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন। এই নির্বাচনের ফলে আওয়ামী লীগ বুঝতে পারবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের জয়ী হতে হলে কেমন প্রার্থী বাছাই করতে হবে। সে দিক থেকেও আওয়ামী লীগেরই জয় হলো। বিএনপি এসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় তাদের মাঠ জরিপও হচ্ছে না। তারা শুধুই আওয়ামীবিরোধী সেন্টিমেন্ট নিয়ে জাতীয় নির্বাচনে পার হতে পারবে না।
তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো বিএনপি বা বড় বিরোধী কোনো পক্ষ নির্বাচনে না থাকলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে মানে বিদ্রোহীদের কাছে দলীয় মনোনয়নের পরাজয় ঘটতে পারে। এই নির্বাচনে আমরা দেখেছি, জায়েদা খাতুন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ১৬ হাজার ১৮৭ ভোটে পরাজিত করেছেন। আজমত উল্লা খান দীর্ঘদিন রাজনীতি করছেন। তিনি তিনবার টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলেন। উচ্চ শিক্ষিত। আর জায়েদা খাতুন রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তিনি স্বশিক্ষিত। মূলত তার ছেলে জাহাঙ্গীরের মাঠ থেকেই তিনি জয়ের মালা এনেছেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব যে বার্তা পেল তা হলো বড় বিরোধী পক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলেও নিজেরই হাতের আঘাত বিক্ষত করতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূল এবং মাঠের সেন্টিমেন্টকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই শিক্ষাও একটা বড় একটা জয়।
চতুর্থত, বিএনপির অভিযোগ ছাড়াও ভূ-রাজনৈতিক ও নানামুখী স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আগামী সংসদ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। এই নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের মধ্যে সেই প্রত্যাশার আলো দেখিয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল এখন পর্যন্ত কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেনি। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে, এটা অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই কূটনৈতিক রাজনীতিতেও এই নির্বাচনের ফলাফল এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান আওয়ামী লীগের জয়কে ইঙ্গিত করে।
সর্বশেষ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আওয়ামী লীগের জয় দেখা যায়। তাহলো নির্বাচনকালীন সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটি এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিরোধী দল তথা বিএনপির দাবির মূল দাবি ছিল এই সরকারের অধীনে শান্তিপূর্ণ বা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এই দাবি নিয়ে যেমন তারা মাঠে সরব, তেমনি কূটনৈতিক চালাচালিতেও সরব। এখন বিদেশিরা নিশ্চয়ই তাদের বলবেন সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আহ্বান করা হয়েছে। তারা বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ হয়তো দেবে। এখন বিএনপি কোথায় যাবে? তারা কি তারপরও বিদেশ নির্ভরতা রাখবে, নাকি যে দাবিতে মাঠ চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করেছে সেটা থেকে সরে আসবে। বিএনপিও এই নির্বাচন নিয়ে কারচুপি বা অশান্তির অভিযোগ আনতে পারেনি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সুযোগ তাদের কমে এলো।
লেখক: সাংবাদিক
ummulwarasweety@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূত্র: দৈনিক দেশরূপান্তর