রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে তৎপরতা বাড়ছে। এরইমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি ও বিএনপি-জামায়াতকে প্রতিহত করা সংক্রান্ত নানা রকম বক্তব্য সামনে এসেছে। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি অনড়। মাঝখানে শান্তিপূর্ণ সমাধান হিসেবে সংলাপের প্রসঙ্গ এসেছে। এ নিয়ে দৃশ্যত দূরত্ব বজায় রেখে বক্তব্য দিলেও কার্যত ভেতরে-ভেতরে সংলাপের তাগাদা অনুভব করছে উভয়পক্ষ। বিশেষত, গত কয়েকমাসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির তাগাদা ও চাপের কারণে উভয় দলই নির্বাচনমুখী সমাধানে তৎপর হয়েছে। যদিও বিএনপি জানিয়েছে, এখনও সংলাপ নিয়ে তাদের প্রস্তুতি নেই।
সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগে আলোচনা আছে, সিদ্ধান্ত হয়নি
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, সংলাপের বিষয়টি মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার আগে আলোচনায় ছিল। এখন সরকার ও আওয়ামী লীগ অন্য বিকল্প নিয়ে ভাবছে। সুতরাং বিদেশি কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে সংলাপের কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলা হলেও তা সিরিয়াসলি এখনও ভাবার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি আসেনি।
আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্যের মতে, সংলাপের জন্য আসলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনও দলই প্রস্তুত নয়। বিএনপির পক্ষ থেকে তো সংলাপের বিষয়ে কোনও বক্তব্য আসেনি। আওয়ামী লীগ কেন খামাখা এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে যাবে। দুই-একজন নেতার বক্তব্যে সংলাপের বিষয়টি যেভাবে এসেছে, তা দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। বরং তা ব্যক্তিগত বক্তব্য হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। কারণ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
বুধবার (৭ জুন) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের দেশে এমন কোনও রাজনৈতিক সংকট হয়নি যে জাতিসংঘের এখানে ইন্টারফেয়ার করতে হবে। বিএনপির সঙ্গে আমাদের আলোচনার বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি। আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করবো। এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করবো। বিগত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী সংলাপের আহ্বান করেছিলেন।’
এর আগে মঙ্গলবার (৬ জুন) ১৪ দলের এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই। প্রয়োজনে অতীতের মতো জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের মধ্যস্থতায়ও সেই আলোচনা হতে পারে।’
সংলাপ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা শুরু হলে একদিন পরে আগের বক্তব্য থেকে সরে আসেন আমির হোসেন আমু। বুধবার (৭ জুন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘আলোচনার জন্য কাউকে বলা হয় নাই, কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয় নাই। কাউকে আহ্বান করা হয় নাই। কাউকে আহ্বান করার সুযোগ নাই। এটা আওয়ামী লীগের বাড়ির দাওয়াত নয় যে দাওয়াত করে এনে খাওয়াবো।’
বুধবার আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সংলাপ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নিয়ে আমির হোসেন আমুর বক্তব্য তার ব্যক্তিগত। এটি সরকার বা আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের বক্তব্য নয়।’
আবার একই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমাদের এক নেতা বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কথা বলেছেন। অবশ্যই সংলাপ ও আলোচনার বিকল্প কিছু নেই। আওয়ামী লীগ সংলাপে বিশ্বাসী।’
দলের নেতাদের নানামুখী বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ-কেউ অবশ্য সংলাপেই সমাধান দেখছেন। তবে দলের অবস্থান চূড়ান্ত হওয়ার আগে তারা কেউই উদ্ধৃত হতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, ভিসানীতিসহ নির্বাচনকেন্দ্রীক যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সংলাপই রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। তবে সংলাপ নিয়ে বিএনপির ইতিবাচক সাড়া পেলে ক্ষমতাসীনরাও সেপথে হাঁটতে পারে। পরিস্থিতির ওপর সেটা নির্ভর করছে, বলে জানান কোনও-কোনও নেতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমাদের নেত্রী তার সবশেষ ব্রিফিংয়ে সংলাপের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও স্পষ্ট বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের আলোচনার বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি। জাতিসংঘের ইন্টারফেয়ার করতে হবে দেশে এমন কোনও রাজনৈতিক সংকট হয়নি। আমিও একই কথা বলছি।’
এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনও সুযোগ নেই উল্লেখ করে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘সংলাপ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। দলের কেউ কেউ রাজনৈতিক বক্তৃতায় হয়তো এ নিয়ে কথা বলেছেন। তবে সেই কক্তব্য কোন পরিপ্রেক্ষিতে, কী বলেছেন, সেটিও তো একটা বিষয়। রাজনীতিকরা বিভিন্ন সময় অনেক কথা বলে থাকেন, সব তো বিবেচনায় আসে না। সংলাপ নিয়ে নতুন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, এটা পরিষ্কার। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেবেন।’
আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট হতে চায় বিএনপি
নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ নিয়ে নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি। দুইদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রী পর্যায় থেকে সংলাপ নিয়ে নানামুখী বক্তব্য আসায় পরিস্থিতির দিকে মনোযোগ রাখছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। স্পষ্ট হতে চাইছেন আওয়ামী লীগের আসল উদ্দেশ্য আসলে কী, সেব্যাপারে। সেক্ষেত্রে প্রকাশ্য ও পর্দার আড়ালে ঘটমান পুরো পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষে বিএনপির নেতারা।
নির্বাচনি সংলাপ নিয়ে গত বছর থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা পরস্পরবিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। অতিসম্প্রতি আবারও এই সংলাপ প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের নিয়মিত বিরতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কারণে সংলাপ নিয়ে আবারও আলোচনা সামনে এসেছে। বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে গত কয়েক মাসে দফায়-দফায় বৈঠকে মিলিত হয়েছেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা।
সর্বশেষ গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে আয়োজিত বৈঠকে অংশ নেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মো. আলী আরাফাত (এম এ আরাফাত), বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল।
এক্ষেত্রে পর্দার আড়ালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনও সংলাপ হচ্ছে কিনা, এমন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কাছে দাবি করেছেন, ‘আলাপ নাই। আমাদের সঙ্গে কারও কোনও আলাপ নাই।’
এ প্রসঙ্গ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘না, ওটাকে সংলাপ বলার কোনও সুযোগ নাই। আমরা সেদিন আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছিলাম।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্তত তিন জন সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, প্রথমত সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের দুই রকম বক্তব্যে বিএনপিও বিভ্রান্তিতে আছে। আসলে সরকার কী চাইছে, তা ঠিক নিশ্চিত হতে পারছে না বিএনপি। পরিস্থিতি সংকটের দিকে ধাবিত হবে, নাকি সহজভাবে সমাধান হবে- পুরো বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করছে বলে জানান একাধিক নেতা।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য মনে করেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর সুযোগ; এক-এগারোর সময়ের সরকারের আমলে করা মামলা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে আলোচনায় বসার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আর আলোচনার ইস্যু থাকতে পারে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যু। এই এইস্যু সুনির্দিষ্ট করা ছাড়া বিএনপির সংলাপে যাওয়া ঠিক হবে না।
এরইমধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাড়ে ১৩শ মামলা নিয়ে সরকার মাঠে নেমেছে।
দলের আরেক সদস্য বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের সংলাপেই স্পষ্ট করেছেন, তিনি আসলে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ। সে অভিজ্ঞতায় বলা যায়, তার (সরকার থেকে) পদত্যাগের শর্ত ছাড়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনও সংলাপে বসা সঠিক হবে না।’
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও দায়িত্বশীলরা মনে করছেন, বিএনপির পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করার মতো শক্তি নেই। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি শান্তপথে না গেলে দেশি-বিদেশি পাওয়ার পকেটগুলো নিজেদের কৌশলে এগুবে। তবে সরকার নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেলেও সেই নির্বাচনে বিএনপি যাবে না।
সংকট সমাধান নিয়ে ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর দেওয়া বক্তব্য নিয়ে কোনও কমেন্ট করতে চান না মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বুধবার বিকালে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কোনও কথাও বলতে চাই না। উনি আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল স্পোকসম্যান কিনা এটা আমি জানি না। আই ডোন্ট মেক অ্যানি কমেন্ট।’
২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন নেতার সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্ততায় বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীও ছিলেন।
বুধবার রাতে সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘সংলাপ নিয়ে পরিষ্কার কিছু হচ্ছে না। আমির হোসেন আমু সংলাপের বিষয়ে বললেও বুধবার সকালেই কিন্তু ওবায়দুল কাদের সাহেব নাকচ করেছেন। তারা বলছে এখনও সময় আসেনি। আজ আরও কয়েকজন নেতাও এ কথা বলেছেন। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা সংলাপে বিশ্বাসী। ফলে, এখনই সংলাপের সম্ভাবনা নিয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি।’ সূত্র:বাংলাট্রিবিউন।
ভয়েস/জেইউ।