শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৭ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

রাজনীতির গরু বাণিজ্যের গরু

মযহারুল ইসলাম বাবলা:
মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্বণ কোরবানির ঈদ। অতীত আর বর্তমানের এই ঈদ পালনে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এখন কোরবানি ঈদে পশু কোরবানি দেওয়া ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাও সত্য, কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য খুব কম লোকেরই থাকে। আমাদের মোট জনসমষ্টির ১৫ ভাগ পরিবারে কোরবানি ঈদ আসে উদযাপনের বারতা নিয়ে। বাকি ৮৫ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষে আর্থিক কারণে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হয় না। গ্রামে ভাগে কোরবানি দেওয়ার প্রচলন অতীতেও ছিল, আজও আছে। কিন্তু সামাজিক জীবনে পরস্পর বিচ্ছিন্ন শহরের মানুষেরা ভাগে কোরবানি দেয় না। দিলেও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির খুবই নগণ্য অংশ। আমাদের দেশে কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে গরুই বেশি। নিম্নমধ্যবিত্তদের একটি অংশ অর্থনৈতিক কারণে খাসি কোরবানি দেয়। আমাদের দেশে কোরবানি দেওয়া–না দেওয়ার ওপর মানুষের সামাজিক মর্যাদাও নির্ভর করে। এই সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় ঋণ করেও অনেকে কোরবানি দেন। কোরবানির গরু নিয়েও এক ধরনের সামাজিক প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। কে কয়টি এবং কত বড় গরু কোরবানি দিচ্ছে এ নিয়ে ঠান্ডা প্রতিযোগিতাও দেখা যায়। অর্থাৎ ধর্মীয় বিধানের চেয়েও সামাজিক মর্যাদার অংশ হয়ে পড়েছে কোরবানি দেওয়া-না দেওয়ার বিষয়টি।

ব্যক্তিগতভাবে ইরাকের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহরে পাঁচ বছর ছিলাম। কোরবানির ঈদের দিন বাগদাদ, বসরা, মশুল, কিরকুক, রামাদি, ফালুজা, আল-কাইম, আকাসাত পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শহরে ঘুরে পশু কোরবানি দেওয়ার দৃশ্য কখনো দেখিনি। এ নিয়ে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলে তারা জানিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, আমরা নিশ্চয় কোরবানি দিই। তবে সেটা হজের সময়। পশু কোরবানি দেওয়া হজের আনুষ্ঠানিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে প্রতি বছর পশু কোরবানি দিই না। প্রতি বছর পশু কোরবানি দেওয়ার বাধ্যবাধকতার বিধান নেই।’

আমাদের দেশের মানুষের প্রোটিন চাহিদা পূরণে গরুর মাংস ছিল তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে সস্তা খাবার। কিন্তু গত কয়েক বছরে ক্রমান্বয়ে গরুর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে গরুর মাংস খাওয়া আর সম্ভব হয় না।

পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের অনেক প্রদেশে গরু জবাইকে কেন্দ্র করে নানা অঘটনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনেক প্রদেশে আইনসিদ্ধ উপায়ে এটা নিষিদ্ধ। বিজেপি ক্ষমতা গ্রহণের পর বিজেপি-শাসিত রাজ্যে এবং অন্যান্য রাজ্যেও গো-হত্যা নিষিদ্ধ করেছে। অবিভক্ত বঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা ৫২ শতাংশ এবং হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৪৮ শতাংশ। তুলনামূলক মুসলমান জনসংখ্যার সংখ্যাধিক্য অঞ্চলে গরু জবাই নিয়ে তেমন বিরোধ-বিরোধিতা তখন ছিল না। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ পৃথক রাষ্ট্রের অধীনে হলেও সেখানে অতীতের মতো এখনো গরু জবাই হয়। পূর্ববঙ্গে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের কারণে গরু জবাই নিয়ে কখনো বিরোধ সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। আমরা যে অল্প মূল্যে গরু এবং গরুর মাংস কিনতে পারতাম তার প্রধানতম কারণ ছিল ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি সম্প্রদায় গো-মাংস খায় না বলে।

কলকাতায় গেলে দেশের চেয়ে প্রচুর সস্তায় গরুর মাংস খাওয়া সম্ভব হয়। বিহারি মুসলিম হোটেলগুলোতে গরুর মাংসের নানা পদের গুরুপাকের রান্না মাংস ভীষণ স্বল্পমূল্যে খাওয়া যায়। মাত্র বছর পূর্বে আগের দামের চেয়ে দ্বিগুণ দামে হোটেলে গরুর মাংসের বিক্রি দেখে দোকানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। দোকানি হিন্দিতে যা বলেছিল তার বঙ্গানুবাদ হচ্ছে, কলকাতায় মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরাও গরু খাওয়া শুরু করার পর গরুর মাংসের মূল্য বেড়ে গেছে। এ ছাড়া সব ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব তো রয়েছেই। সেটাও গরুর মাংসের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ভারতের বর্তমান শাসক দল হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি। এই দলটি নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভে ক্ষমতায় এসেছে। বহির্বিশ্বে গো-মাংস রপ্তানিতে দেশটি শীর্ষে অবস্থান করলেও কয়েক বছর আগে বিজেপি সরকার ধর্মীয় বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে আমাদের দেশে গরু এবং গরুর মাংসের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বলে চোরাইপথে কিন্তু গরু আসা রোধ হয়নি।

বাংলাদেশে গরুর চাহিদা বিবেচনায় ভারতের খামারিরা গরু পালনে দীর্ঘকাল যাবৎ জীবিকা অবলম্বন করে এসেছে। বাংলাদেশের গরুর বাজারের ওপর প্রচুর ভারতীয় খামারিরা নির্ভরশীল। হঠাৎ গরু রপ্তানি বন্ধে ভারতীয় খামারিদের জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ আগাগোড়া ভারতীয় গরুনির্ভর বলেই দেশে গরুর খামার ব্যবসায়ীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়নি। দেশীয় খামারিদের গরু পালন ব্যয়সাপেক্ষ বলেই গরুর প্রকৃত মূল্য না পাওয়ার আশঙ্কায় গরু পালনে খামারিরা উৎসাহী হয়নি। ভারতীয় গরুর মূল্য দেশীয় খামারে পালিত গরুর মূল্যের চেয়ে অধিক কম হওয়ায় গরু পালনে আমাদের খামারিদের অনীহা ছিল। তবে ভারত সরকার গরু রপ্তানি বন্ধ করার পর বাংলাদেশে গরু ব্যবসায়ী-খামারিদের মধ্যে গরু পালনে আশাপ্রদ সাড়া পড়েছে। চোরাইপথে ভারতীয় খামারিদের গরু আসা কমলেও, বন্ধ নেই। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকেও গরু আসে।

ভারতের গরু না আসার কারণে আমাদের দেশে গরু উৎপন্ন ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। গত ক’বছরে আমাদের দেশে উৎপাদিত গবাদি পশুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার গবাদি পশুর খামারিদের জন্য ৫ শতাংশ সুদে ঋণসুবিধা প্রদানও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। কোরবানি ঈদের চাহিদা দেশীয় গরু দিয়ে মেটানো যাবে বলে মত দিয়েছে খামারি, মাংস, চামড়া ব্যবসায়ী সংগঠন এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। তারা পর্যাপ্ত গবাদিপশু মজুদের কথাও বলছেন বটে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এত দ্রুত বা কম সময়ে কোরবানি ঈদে গবাদি পশুর চাহিদা দেশের গবাদিপশু দিয়ে পূরণ সম্ভব হবে না।

দেশে কোরবানি ঈদে গবাদি পশুর প্রয়োজন এক কোটির অধিক। এই বিশাল চাহিদা দেশে পালিত গবাদিপশু দিয়ে পূরণ হবে না। ঘাটতি পড়বে। যদিও ঘাটতির সুযোগটি নিতে মধ্যস্বত্বভোগী, পাইকার ও খামারিরা গ্রহণের অভিপ্রায়ে ঈদে গবাদি পশুর ঘাটতি হবে না বলে জোর প্রচার চালায়।

আমরা নিশ্চয় গবাদি পশুর পরনির্ভরতা অতিক্রম করে স্বাবলম্বী হবো। কিন্তু সে জন্য সময়ের প্রয়োজন। যা দু-চার বছরে সম্ভব হবে না। পূর্বে ভারত থেকে ২৫-৩০ লাখ গরু এলেও গত ঈদের সময় এসেছিল মাত্র আড়াই-তিন লাখ গরু। এ কারণে গত কোরবানি ঈদের বাজেট কারও পক্ষেই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। গরু কিনতে সবারই বাজেট ঘাটতি হয়েছিল।

বাংলাদেশ গবাদি পশুর চাহিদায় স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করা হলেও গরু এবং গরুর মাংসের দর কমার কিন্তু কোনো সম্ভাবনা নেই। দরবৃদ্ধি ঘটবে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মতো। আসলে বাজার ব্যবস্থায় ঘাটতি এবং মজুদদারির কারসাজিতে দরবৃদ্ধির ঘটনা আমাদের অভিজ্ঞতাজুড়ে রয়েছে। গরুর ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটবে না, সে নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সততার লক্ষণ খুবই ক্ষীণ।

বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০-৮০০ টাকা। বছর ঘুরতেই এটা হাজারে অতিক্রম করলে বিস্মিত হবো না। দেশে খাদ্যপণ্যের দর আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো শাসকের শাসনামলে বাজার ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা অতীতেও ছিল না, ভবিষ্যতে থাকবে, সেটাও আশা করা যাবে না। আমাদের ব্যবসায়ীরা শাসকশ্রেণির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই তাদের মুনাফা নিয়ন্ত্রণে কোনো সরকারই এ যাবৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

mibabla71@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION