রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৬ পূর্বাহ্ন
এইচ এম মনিরুজ্জামান:
মানুষের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি দয়াময় সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার বিশেষ দান। এই উপলব্ধি মানুষকে আল্লাহমুখী হতে এবং চিন্তা ও শক্তিকে সঠিকভাবে সঠিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে সহায়তা করবে। মহান আল্লাহর এই দানকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এই দানকে অবহেলা করা, এই শক্তি ও যোগ্যতাকে ব্যবহার না করা কিংবা অন্যায় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা অকৃতজ্ঞতারই নামান্তর। কাজেই একজন মুমিন ইমানের প্রেরণা থেকেই যে বিষয়গুলো অর্জন করবেন তা হচ্ছে
ক. নিজের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তিকে আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতা ও আল্লাহর নেয়ামত বলে বিশ্বাস করবেন।
খ. এই গুণ ও যোগ্যতার বিষয়ে অবহেলা করবেন না এবং একে অকার্যকর করবেন না।
গ. অন্যায় ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করবেন না।
ঘ. সত্য-ন্যায়ের ক্ষেত্রে এবং শরিয়তসম্মত উপকারী ক্ষেত্রগুলোতে তা ব্যবহার করবেন।
এখানে আরও যে বিষয়টি বোঝা যায় তা হচ্ছে, মুমিনের সব চেষ্টা-তদবির হতে হবে শরিয়তের গন্ডির ভেতরে। কারণ, আল্লাহর বিধান অমান্য করে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া এবং আল্লাহর ওপর ভরসার কথা বলা শুধু হাস্যকরই নয়, বেয়াদবিও বটে।
দুনিয়াদারের চেষ্টা-তদবির আর ইমানদারের চেষ্টা-তদবিরের মধ্যে আরেক পার্থক্য এটা। দুনিয়াদার চেষ্টা-তদবির করে কিন্তু সেক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের, জায়েজ-নাজায়েজের পরোয়া করে না; পক্ষান্তরে ইমানদারও চেষ্টা-তদবির করেন কিন্তু তিনি আল্লাহর বিধানের অনুগত থাকেন, জায়েজ-নাজায়েজের সীমানার ভেতরে থাকেন। কেন তিনি চেষ্টা-তদবিরের ক্ষেত্রে এই সীমানা লঙ্ঘন করবেন? তার তো বিশ্বাস আমার চেষ্টা-প্রচেষ্টা উপায়মাত্র। ফলাফল তা-ই হবে, যা আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা। কাজেই কেন আমি চেষ্টা করতে গিয়ে আল্লাহতায়ালাকে নারাজ করব?
হাদিসে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি শেখানো হয়েছে। সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দুর্বল মুমিন অপেক্ষা সবল মুমিন শ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। (তবে) প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ আছে। তোমাকে যা উপকার দেবে সে বিষয়ে লালায়িত হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো। অক্ষম অকর্মন্য হয়ো না। কোনো (অবাঞ্ছিত) বিষয়ে আক্রান্ত হলে বলো না- যদি আমি এই করতাম তাহলে এই এই হতো; বরং বলবে, আল্লাহর ফয়সালা; তিনি যা চান তা-ই করেন। কারণ, ‘যদি’ কথাটা শয়তানের কাজের পথ খুলে দেয়।’ -সহিহ মুসলিম : ২৬৬৪
আলেমদের পরামর্শ হলো- কেউ যখন দুনিয়ার কোনো কাম্য বস্তু লাভে ব্যর্থ হয় তখন সেই বিষয়ের দুঃখ ও আফসোসে নিজেকে ব্যস্ত করবে না। কারণ এতে একে তো তাকদিরে অসম্মতি প্রকাশ করা হয়, দ্বিতীয়ত এই দুঃখ-আফসোসে কোনো উপকার নেই। বরং এ কারণে অপ্রাপ্তির ক্ষতিপূরণ হতো এমন উপকারী কাজ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। তো সারকথা এই যে, ‘যদি’ ব্যবহারে যদি বর্তমানের কোনো ভালো কাজের ক্ষেত্রে অবহেলা হয় কিংবা অতীতের কোনো ব্যাপারে তাকদিরে অসম্মতি প্রকাশ করা হয় তা হবে নিন্দনীয় ও বর্জনীয়। আর দ্বিতীয়টা প্রথমটার চেয়েও অধম।
ইমাম সুবকি (রহ.)-এর এ বক্তব্যে শুধু আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যা নয়, এ বিষয়ক অন্যান্য হাদিসের সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও পাওয়া গেল। তবে সহিহ মুসলিমের আলোচ্য হাদিসে প্রধানত দ্বিতীয় শিক্ষাটি পাওয়া যায়। যার সারকথা হচ্ছে, মুমিন দ্বীন-দুনিয়ার কাম্য ও উপকারী বিষয়টি অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, অবাঞ্ছিত ও ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে আত্মরক্ষার সযতœ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু এর পরও ফলাফল যদি অন্যরকম কিছু হয় তাহলে একে আল্লাহর হুকুম বলে মেনে নেবে। কর্মপ্রচেষ্টার এর চেয়ে সুন্দর, বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা আর কী হতে পারে?
দুনিয়ার এ ঘরকে আল্লাহ যেহেতু কর্ম ও প্রচেষ্টার ঘর বানিয়েছেন তাই বান্দাকে কর্মতৎপর থাকতে হবে। কর্মের শক্তিও তো আল্লাহতায়ালাই দান করেছেন। কাজেই কর্মবিমুখ হওয়া এই নেয়ামতের না-শোকরি বটে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ফলাফলের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা উপায় মাত্র, তাই বান্দা সব প্রচেষ্টার পরও আল্লাহর ওপর ভরসা করবে এবং ফলাফল ভালো হলে আল্লাহর শোকর করবে। ফলাফল ভিন্ন কিছু হলে সবর করবে ও তাকদিরের ফয়সালায় সম্মত থাকবে। বলাবাহুল্য, এই শিক্ষাকেই বলা যায় কর্মপ্রচেষ্টার উৎসাহদানের সঠিক ও সম্পূর্ণ শিক্ষা।
ভয়েস/আআ