বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:২৮ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
চলতি বছর ১৮ লাখের বেশি মানুষ পবিত্র হজ পালন করেছেন। তন্মধ্যে বাংলাদেশি হাজির সংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজারের মতো। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হাজিরা হজপালন শেষে মক্কা থেকে নিজ নিজ দেশে ফেরা শুরু করেছেন। বাংলাদেশের হাজিরাও ঘরে ফিরছেন। হজপালন করে আসা হাজি সাহেবদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। দোয়া করি তাদের বরকতে সমাজ আলোকিত হোক।
হজ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে পাঁচটি বিষয়ের ওপর ইসলামের মূল ভিত্তি, তার পঞ্চমটি হজ। তবে হজের বিধানটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, এটি মুসলমানের ওপর প্রতিদিন অথবা প্রতি বছর ফরজ হয় না; জীবনে মাত্র একবার ফরজ হয়।
হজপালন আল্লাহর প্রতি বান্দার অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সম্পদশালী, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার হজ ফরজ। বিপুল অর্থ ব্যয় করে মক্কার নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট আচার-আচরণ নির্দিষ্ট দিনে আদায় করতে হয়। হজের ফজিলত প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করল এবং অশ্লীল কথাবার্তা ও গোনাহ থেকে বিরত থাকল সে ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ থেকে ফিরে আসবে, যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। -সহিহ বোখারি : ১৫২১
ইসলামি স্কলাররা বলেন, হজপালনের জন্য মক্কা গমন এবং কিছু আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদনের মধ্যেই হজের উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় না। বরং হজ-পরবর্তী সময়েও রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ জীবনযাপন ও আমলি জিন্দেগি। হজের পর গোনাহমুক্ত জীবনযাপনই হলো হজ কবুল হওয়ার লক্ষণ। হজের পর হাজিদের উচিত আল্লাহর বিধিবিধান পালনের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করা। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, ‘হজ-পরবর্তী জীবনে হজপালনকারী তার ভালো কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। যাবতীয় পাপের কাজ থেকে দূরে থাকে। তাহলে ধারণা করা যায়, তার হজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে।’
সে হিসেবে আলেমরা বলেন, হজ-পরবর্তী সময়ে সমাজে ভালো কাজের অংশগ্রহণ বাড়ানো। অন্যায় প্রতিহত করতে নবী কারিম (সা.)-এর দেখানো পন্থায় চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যাওয়া। নিজে যেমন অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকবে, তেমনি অন্যকেও সব ধরনের অন্যায় থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট থাকবে।
হজপালনকারীরা অনেক কষ্ট করে শারীরিক ও আর্থিক এই ইবাদত সম্পাদন করেছেন। যাদের হজ কবুল হয়, তাদের জীবনের মোড় ও কর্মের অভিযাত্রা ঘুরে যায়। ভবিষ্যতে গোনাহ থেকে বিরত থাকার আগ্রহ বাড়ে। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষ যতœবান হয়। হজের পর যার জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। হাদিসে বলা হয়েছে, মাবরুর হজ (কবুল হজ) নসিব হলে, হজপালনকারী সদ্যপ্রসূত ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। তাই হজপালনকারী হজ-পরবর্তী জীবনে নিজেকে কলুষমুক্ত রাখতে দুনিয়ার সব কাজে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে। নেক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। বিশেষ করে পাপমুক্ত জীবন গঠনে মনোযোগী হওয়া। সহজ ভাষায়, আকাইদ (বিশ্বাস), ইবাদত-বন্দেগি (উপাসনা), মুয়ামালা (লেনদেন), মুয়াশারা (সমষ্টিগত জীবনের নীতি ও বিধান) ও আখলাক (স্বভাব-চরিত্র) ইত্যাদির ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ও নবী কারিম (সা.)-এর সুন্নত মেনে চলা। যারা আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবা স্বচক্ষে দর্শন করেছেন এবং তওয়াফের সৌভাগ্য লাভ করেছেন, যারা আল্লাহর রাসুলের রওজায় সশরীরে উপস্থিত হয়ে দরুদ ও সালাম পেশ করেছেন- তাদের তো নিশ্চয়ই এই প্রেরণা জাগ্রত হয়েছে, ইনশাআল্লাহ- সামনের জীবন আল্লাহর বিধান মোতাবেক ও রাসুলের সুন্নত অনুযায়ী অতিবাহিত করব।
এক কথায়, সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগি পালন করাই হবে একজন হাজির হজ-পরবর্তী জীবন। সুতরাং ফরজ ইবাদতগুলো পালন, সুন্নতে মোয়াক্কাদাকে গুরুত্ব দেওয়া, সাধ্যমতো নফল আদায়ের চেষ্টা, নিয়মিত কিছু পরিমাণে হলেও কোরআন তেলাওয়াত, বিভিন্ন সময়ের দোয়া পাঠ, কিছু পরিমাণে আল্লাহর জিকির ও ইস্তেগফার ইত্যাদিতে মনোযোগী হওয়া। সর্বাবস্থায় লেনদেনে হারাম উপার্জন ত্যাগ করা এবং অন্যের পাওনা পরিশোধ করা অতি জরুরি। মনে রাখতে হবে, লেনদেনে হারাম ছাড়তে না পারলে দ্বীনদার হওয়া যায় না। সুদ, ঘুষ ও অন্যান্য হারাম থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করতে হবে এবং হালাল উপায়ে যতটুকু উপার্জন হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। সেই সঙ্গে প্রত্যেকের হক সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা আদায় করা। পিতা-মাতার হক, আত্মীয়-স্বজনের হক, পাড়া-প্রতিবেশীর হক, সহকর্মী ও দায়িত্বশীলের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, এমনকি অমুসলিম ও পশু-পাখির হকও ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞানার্জন করে সে অনুযায়ী নিজের কর্ম ও জীবন পরিচালিত করতে হবে।
স্বভাবের ভালো বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন বিনয়, নম্রতা, ক্ষমাশীলতা, উদারতা, সংযম, পরোপকার, অন্যের হিত কামনা ইত্যাদি জাগ্রত ও কার্যকর করা এবং স্বভাবের মন্দ প্রবণতাগুলো যেমন অহংকার, ক্রোধ, কৃপণতা, অসংযম, অন্যের অনিষ্ট কামনা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা একজন ভালো মানুষ হওয়ার বিকল্পহীন বিষয়। একজন সাধারণ মানুষের অসৎ আচরণের চেয়ে একজন হাজি সাহেবের অসৎ আচরণ অধিক দৃষ্টিকটু। এ কারণে তাদের আচার-ব্যবহার সুন্দর ও শালীন হওয়া অধিক কাম্য।
নামের আগে আলহাজ বা হাজি উপাধি ব্যবহার করা কিংবা হজপালন করে এসে নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড়, আলাদা কিছু কিংবা বেশি সৌভাগ্যবান মনে করা অনুচিত। হ্যাঁ, একজন হাজি সাহেবের জীবন তখনই সৌভাগ্যবান হবে, যখন তার হজ-পরবর্তী জীবন হবে আল্লাহ-রাসুলের দেখানো পথে। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানো যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগি থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
muftianaet@gmail.com
ভয়েস/আআ/দেশরূপান্তর