বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪৯ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নিজেদের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ আর কত?

রায়হান আহমেদ তপাদার:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নড়াচড়া দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ ততই বাড়ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বড় ধরনের বিভাজন আছে। আর এই সময়ে বিভাজনকে কেন্দ্র করে বিদেশি কূটনীতিকরা বেশি মাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠেন। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিরা বিভাজিত রাজনীতির মেরুকরণে তাদের তৎপরতাকে ব্যবহার করতে চায়। এই সুযোগটাকে কাজে লাগান এসব কূটনীতিক, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালান। তারা কতগুলো পদক্ষেপ নেন। কিছু কথাবার্তাও বলে থাকেন। আগামী বছরের প্রথমেই যেহেতু জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা, তাই কূটনীতিকদের এই ভূমিকা আবার দেখা যাচ্ছে। আমরা জানি, নির্বাচনের আগে অনেক কিছুই এখানে হবে। অনেক কিছুই ঘটবে। এগুলো নিয়ে চিন্তার কিছু দেখছি না। বিদেশিরা নিজেদের স্বার্থ বেশি দেখেন। তাদের নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য যদি ঠিক থাকে, তাহলে তারাও চুপ হয়ে থাকবেন। তারা নিজেদের স্বার্থ ঠিক রেখে সম্পর্ক তৈরি করেন।

একটি দেশ যখন কথা বলবে, অন্য দেশ কেন মেনে নেবে? স্বাভাবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের ইস্যুতে বক্তব্য দিচ্ছে; রাশিয়াও পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছে। কারণ, পৃথিবী আর আগের মতো নেই। এগুলো নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো কিন্তু অনেক দেশের অগণতান্ত্রিক সরকারের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে। সেসব দেশের সরকারদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কথা বলে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে আমরা প্যালেস্টাইনকে দেখতে পাই। সেখানে ইসরায়েল সরকারের দখলদারিত্ব, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কিন্তু পশ্চিমারা নিশ্চুপ। বরং তাদের প্রচ্ছন্ন মদদে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি এসব অগণতান্ত্রিক নিপীড়নের কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো যদি এতই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকত, তাহলে ইসরায়েলের প্রতি তাদের এই সমর্থন অব্যাহত থাকছে কেন। আমরা এটাও দেখেছি, আফগানিস্তানে তারা ২০ বছর ধরে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখলেও কোনো গণতান্ত্রিক কাঠামো সেখানে তৈরি হয়নি। মিসরে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার জন্য তারা সেনা পরিচালিত সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। এ রকম একাধিক উদাহরণ থেকে দেখা যায়, সেখানে গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। সুতরাং তাদের ভূমিকা কতটুকু গণতন্ত্রের সপক্ষে থাকে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। মূল কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের রাজনীতির বিভাজন যতদিন থাকবে, ততদিন এসব বিষয় থাকবে। কিন্তু এতে গণতন্ত্রের কী লাভ হবে, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বেড়ে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি আর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকসহ প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে বড় দলগুলোর যোগাযোগ। তাদের উৎসাহী অবস্থান কূটনীতিকদের নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়। সাম্প্রতিক সময়েও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। এবারের বিশেষত্ব বড় কূটনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে মেরুকরণ। কারণ ইতিমধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আবার পশ্চিমা দেশগুলোর বিপরীতে থাকা চীনের রাষ্ট্রদূত ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে করারও অধিকার নেই বলে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে স্পষ্টত চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত ইয়ান ওয়েন এক আলোচনা সভায় সরাসরি বলেছেন, চীন কোনো দলের পক্ষে নয় রাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করে যায়। তাই কোন দল ক্ষমতায় থাকল না থাকল সেটি তাদের বিষয় নয়। ঠিক একই কথা খাটে ভারতের হাইকমিশনারের বিষয়েও। এখন পর্যন্ত হাইকমিশনারের মুখ থেকে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কোনো মন্তব্য বা পরামর্শ আলোচনায় আসেনি।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ আছে কি না। দেশের অনেক রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে এবং বিশেষ করে নির্বাচনের আগে। অনেকে আবার নির্বাচনের আগে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতাকে হস্তক্ষেপ বলতে রাজি নন। তারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকায় তা মেটাতে বিদেশি কূটনীতিকরা একধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা করেন। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়ী করেন তারা।

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি প্রধান দুই দলই বলছে, বিদেশি হস্তক্ষেপ নেই। সরকারে থাকলে একরকম এবং ক্ষমতার বাইরে থাকলে তাদের ভিন্ন মনোভাব প্রকাশ পায় বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে। যে দল ক্ষমতার বাইরে থাকছে, তাদের নির্বাচন, মানবাধিকারসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিতে দেখা যায়। ক্ষমতার আসনে থাকা দল তখন এর সমালোচনা করে থাকে। এ ছাড়া বিদেশিদের বক্তব্য যদি কোনো দলের বিপক্ষে যায়, তখন সেই দল সেটিকে চাপ এমনকি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে থাকে।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা বিভিন্ন বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন। নির্বাচনের আগে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ বা তৎপরতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার একটু ভিন্ন চিত্র যেটা দেখা যাচ্ছে প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকদের অনেকের বক্তব্যে কোনো না কোনো পক্ষে তাদের অবস্থান প্রকাশ পাচ্ছে। সে কারণেই বিদেশি হস্তক্ষেপ বা চাপের বিষয় নিয়ে এবার বেশি আলোচনা হচ্ছে। তবে দুই দলই নির্বাচনের আগে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতাকে বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলতে রাজি নয়। বরং তারা বিরোধী পক্ষের ওপর চাপ হিসেবে একে ব্যাখ্যা করছে। এ ব্যাপারে তারা একমত বলে মনে হয়েছে। তবে বর্তমান বিশ্বরাজনীতির কারণে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকরা ভিন্ন ভিন্ন পক্ষ নিচ্ছেন কি না, এই প্রশ্ন রয়েছে।

বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন চীন, ভারত ও রাশিয়া সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা দেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সমর্থনে কথা বলছেন। এ ধরনের ধারণা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে পশ্চিমাদের সমালোচনা করে বক্তব্যও দিচ্ছেন।

বাংলাদেশে যেহেতু নির্বাচনীব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ আছে, সেই পটভূমিতে এই বিশ্বে এক দেশ অন্য দেশের অংশীদার হিসেবে সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে। এটি যেমন কূটনৈতিক সম্পর্কের অংশ; আবার উন্নয়ন সহযোগী হিসেবেও তারা কথা বলে থাকে। তবে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা এখনো প্রতিষ্ঠা করা যায়নি বিধায় বিদেশিরা এমন সুযোগ নিচ্ছেন বা পাচ্ছেন। এবং এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধের কারণে বিদেশিদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এই বক্তব্যের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদেরও সন্দেহ নেই বলা যায়। কিন্তু তাদের বিরোধ যতদিন জিইয়ে থাকবে এবং নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারবেন না; ততদিন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কথা বলার বা চাপ সৃষ্টির সুযোগ থেকে যাবে। বড় দুই দলেরও এর সঙ্গে দ্বিমত থাকার কথা নয়। তারা কি কখনো সমাধানের পথে হাঁটবেন সেই প্রশ্ন ঝুলে আছে।

ক্ষমতায় থাকা দলের নেতারা কূটনীতিকদের খুব বেশি দৌড়াদৌড়ি পছন্দ করেন না। কিন্তু বিরোধী দলে থাকলে তারা বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস নিয়ে নানা মন্তব্য করেন বিদেশি কূটনীতিকরা। তবে বাস্তবে দেশের রাজনৈতিক দুর্বলতা কূটনীতিকদের তৎপরতা বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে যতদিন পর্যন্ত সুস্থ ধারা ফিরে না আসবে, ততদিন বিদেশিদের নাক গলানোর প্রবণতাও দূর হবে না। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বড় দুর্বলতা যে, আমরা নিজেদের নাক কেটেও পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে চাই। রাজনীতিবিদরা নিজেরা নিজেদের শুধরে না নিলে বিদেশিদের আনাগোনা কখনোই বন্ধ হবে না। আর তাতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বই ভালো কিছু হবে না। তাই সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

raihan567@yahoo.com

সূত্র: দেশ রূপান্তর/ভযেস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION