বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪৯ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
আগামীকাল বহু ঘটনার সাক্ষী মহররম মাসের ১০ তারিখ। দিনটি আশুরা হিসেবে বেশি পরিচিত। পৃথিবীর সৃষ্টি এবং হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে অনেক নবী-রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত দিন আশুরা। মুসলমান ছাড়াও ইহুদি-খ্রিস্টানদের কাছে আশুরা বেশ পবিত্র ও সম্মানিত। আশুরার দিনের মূল ইবাদত হচ্ছে- এ দিনের রোজা রাখা। এ দিনের রোজার ফজিলতের ব্যাপারে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা রাখি, তিনি পূর্বের এক বছরের (সগিরা) গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ -সহিহ মুসলিম : ১১৬২
আশুরার দিন রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি আমল। এ দিন রোজা রাখা মোস্তাহাব। তবে উত্তম হলো, দশ মহররমের আগে বা পরে ৯ বা ১১ তারিখে একদিন অতিরিক্ত রোজা রাখা। ৯ তারিখে রাখতে পারলে ভালো। কারণ হাদিসে ৯ তারিখের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে হজরত মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়ের অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তিলাভ। এই দিনে আল্লাহতায়ালা লোহিত সাগরে ডুবিয়ে মারেন ফেরাউন ও তার বাহিনীকে। ঘটনাটি ইমাম বোখারি (রহ.) তার কিতাবে এভাবে বর্ণনা করেন, ‘হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারিম (সা.) যখন হিজরত করে মদিনা পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে, মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ হজরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফেরাউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, হজরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন।’ -সহিহ বোখারি : ৩৩৯৭
আগেই বলা হয়েছে, নবী-রাসুলদের স্মৃতিবিজড়িত দিন আশুরা। আশুরা আমাদের কাছে গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার আরও কারণ হলো- এ দিনেই (৬১ হিজরির ১০ মহররম) আমাদের প্রিয়তম নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) সপরিবারে কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। এ ঘটনা এত মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক যে কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের অন্তরকে তা নাড়া দেবে এবং এর আবেদন কখনো ফুরাবে না। তিনি যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা হননি, তার সঙ্গে ছিল তার পরিবারের নারী-শিশুসহ মাত্র ৭২ জন সঙ্গী-সাথী। সেদিন একটি অসম যুদ্ধে ইমাম শহীদ হয়েছিলেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে স্বৈরশাসনের মোকাবিলা করে জীবন দিতে হয়। শাহাদতের পর থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর কাছে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবেন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস।
হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে সেদিনের যুদ্ধ ছিল মূলত অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের, অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অকল্যাণের বিরুদ্ধে কল্যাণের। অনাদর্শের বিরুদ্ধে আদর্শের, যা অনন্তকালের জন্য আদর্শিক বিজয়ের চেতনা। কারবালার চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনা।
উপরোক্ত ঘটনাবলি ছাড়া মহররম এবং আশুরার সঙ্গে রয়েছে মুসলানদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তবে এটা সুস্পষ্ট যে, আশুরা মানেই কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নয়, আশুরার ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকেই চলে এসেছে। এর ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে। ইসলামের আবির্ভাবেরও বহু আগে থেকে। এমনকি আশুরার রোজার প্রচলন ছিল ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগেও! এমতাবস্থায় আশুরার ঐতিহ্যকে শুধুমাত্র কারবালা দিবসের ফ্রেমে বন্দি করা কাম্য নয়।
মহররম ও আশুরার ইতিহাসের সঙ্গে তওবা কবুল হওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তি, নিরাপত্তা এবং গায়েবি সাহায্য লাভের ইতিহাসজুড়ে আছে। এজন্য এ সময়ে এমন সব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি আরও বেশি ধাবিত হয়। বিশেষভাবে এ সময়ে তওবা-ইস্তেগফারের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী হওয়া।
এক সাহাবি নবীজির কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ! রমজানের পর আপনি কোন মাসে রোজা রাখতে বলেন? নবী করিম (সা.) বললেন, তুমি যদি রমজানের পর রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররমে রোজা রেখো। কেননা মহররম হচ্ছে- আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একদিন আছে, যেদিন আল্লাহতায়ালা (অতীতে) অনেকের তওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তওবা কবুল করবেন। -জামে তিরমিজি : ৭৪১
হাদিসের ব্যাখ্যাকাররা দিনটি আশুরার দিন হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন। বস্তুত তওবা-ইস্তেগফার যেকোনো সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। বান্দা আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করবে, নিজের অতীতের জন্য ক্ষমা চাইবে এটাই তো তার কাজ। কিন্তু আল্লাহর অপার অনুগ্রহ, তিনি সেই আকুতি পেশ করার অর্থবহ শব্দ-বাক্যও বান্দাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। কোরআন-হাদিসে বর্ণিত সেসব দোয়ার মর্ম ও ব্যঞ্জনা মুমিনের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যদি সে উপলব্ধির সঙ্গে সেগুলো পাঠ করে। কোরআন মাজিদে নবীদের অনেক দোয়া উল্লেখ করা হয়েছে, যে দোয়ার অসিলায় তারা আল্লাহতায়ালার বিশেষ রহমত প্রাপ্ত হয়েছেন। মুমিনের জন্য সেগুলো অনেক বড় সম্বল। হাদিসেও অনেক দোয়া-ইস্তেগফার বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোও অজিফা হিসেবে গ্রহণ করা। বিশেষ করে, দেশজুড়ে চলছে ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহতা- এই অবস্থায় আশুরার দিন রোজা পালনের পাশাপাশি, বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করে রোগমুক্তিসহ যাবতীয় বিপদ মুক্তির জন্য বিনয়ের সঙ্গে প্রার্থনা করা। মন দিয়ে গভীরভাবে আশুরা দিনের তাৎপর্য উপলব্ধি করে সে অনুযায়ী জীবন গঠনের শিক্ষা নেওয়া।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
muftianaet@gmail.com
সূত্র: দেশ রূপান্তর/ভয়েস/আআ