বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪৯ অপরাহ্ন
মোস্তফা কামাল :
নির্বাচনের একটা খসড়া রোডম্যাপ জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। বলেছেন, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা আগামী বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। তফসিল অক্টোবরের আগে নয় উল্লেখ করে আগাম ভোটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন সিইসি। রাজনীতি ও নির্বাচনের ডামাডোলে চারদিকে এখন কেবল আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। প্রতিদিনই তাদের কর্মসূচি। বাদবাকিদের ঝরে পড়ার মতো দশা। জাতীয় পার্টি-জামায়াতসহ সাইড লাইনের দলগুলো আরও সাইডে চলে গেছে। সিপিবি, জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির মতো বাম গলি প্রায় অন্ধকারে। তাদের সময় কাটছে সময় বুঝে সাইড খুঁজে নেওয়ার পাটিগণিতে। নতুন বিশ্বপরিস্থিতিতে তাদের বিদেশি প্রভুদের অ্যাটেনশন ভিন্ন দিকে। কোনো না কোনোভাবে বড় দুদল বিএনপি-আওয়ামী লীগেরই পিঠ মুছছে তারা।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বেড়াজালে বাংলাদেশও। ইনক্লুসিভ নির্বাচনের তাগিদ যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর। নির্বাচনের সঙ্গে শর্ত হিসেবে জুড়ে দিচ্ছে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ইত্যাদি শব্দ। পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিনিধিদের সিরিজ আনাগোনা গত ছয়-সাত মাস যাবৎ। সংশ্লিষ্টদের প্রতি নানা আহ্বান তাদের। আর সংশ্লিষ্ট মানে প্রধানত বিএনপি-আওয়ামী লীগ। মাঝেমধ্যে টুকটাক সিরিয়াল পাচ্ছে জাপা-জামায়াত। এসবের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মেইন স্ট্রিম, সাইডলাইন, এক্সট্রা শক্তি অনেকটা পরিষ্কার। নির্বাচন বাংলাদেশের। তাড়না বিদেশিদের। বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এরমধ্যেই বলেছেন যে, বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আবার নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার শঙ্কাও তাদের। এ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে সেই আহ্বানও জানাচ্ছে। স্যাংশনের পর দিয়েছে ভিসানীতিও। বলা হয়েছে, ভিসানীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও সুষ্ঠু নির্বাচন।
নীতি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণœ করায় দায়ী বা জড়িতদের ভিসা দেবে না। এ রেস্ট্রিকশনে পড়বেন বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা। ভিসানীতির জেরে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার সুযোগ পেয়েছে। ক্ষমতাসীনদের বাইরে সুযোগটি নিচ্ছে বিএনপি। কিছুটা জামায়াত। জাতীয় পার্টিসহ সরকারের পছন্দের দলগুলোর গণজমায়েতের সেই সামর্থ্যই নেই। সরকারও বুঝেশুনে গণনায় ধরছে কেবল বিএনপিকেই। দলটিকে মাঠ দখলের সুযোগ দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। তাই বিএনপি পদযাত্রা-সমাবেশ ধরনের কর্মসূচি ডাকলেই পাল্টা ডাক দেয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। এরপরও অনেকের ধারণা ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কারণে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা সংযত থাকবে। কিন্তু, ফল উল্টো হতে শুরু করেছে।
শনিবার ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি পালনে যাওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রধানত পুলিশের এবং কিছু স্থানে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সংঘর্ষ বেধেছে। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর রায়-আমানউল্লাহ আমানকে নাস্তানাবুদের পর ডিবিতে নিয়ে আপ্যায়ন বা হাসপাতালে ফল পাঠিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার একটি সার্কাস ধরনের সংস্কৃতি যোগ হয়েছে। তারপর থানায়-থানায় নামে-বেনামে শত শত মামলার ধুম। গায়েবি মামলার ক্রেজ উঠেছে নতুন করে। বিএনপিকে একমাত্র প্রতিপক্ষের মতো বধ করার সরকারি এ মানসিকতা দলটিকে আরও ফ্যাক্টর করে তুলছে। এর মধ্যেই স্নায়ুচাপের মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন উপসর্গ। নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসানীতি প্রণয়নের পর যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ কংগ্রেসম্যান দেশটির জাতিসংঘের দূতকে চিঠি দিয়ে ‘জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে’ বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জাতিসংঘে উত্থাপনের আহ্বান। এসবের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশে কম্বোডিয়ার একটি ছাপ দেখছেন। তেমন কিছু আশা করার লোকও বাংলাদেশে আছে। এ অভিযোগের তীরটা মূলত বিএনপির দিকেই। বিএনপি বিদেশিদের মদদপুষ্ট হয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করছে বলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা একা নয়, গণতান্ত্রিক বিশ্বও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সরকার আবার যেনতেন নির্বাচনের সুযোগ পাবে না বলে উচ্চাশার কথাও জানান তিনি।
তাদের কথায়ও পরিষ্কার দেশের রাজনীতির বল এখন আর দেশে নেই। এমনকি বিদেশি খেলোয়াড়, আম্পায়ার, কোচও যোগ হয়েছেন। রেফারি এখন পর্যন্ত অচেনা। বিশ্ব পরিস্থতিও একটা ফ্যাক্টর। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৯৭২-৭৫ এ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যেসব নীতিমালা গ্রহণ করেছিল, বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও তা আঁকড়ে ধরেছে। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও আন্তর্জাতিক বেড়াজালের মধ্যে কিছুটা একই কায়দায় একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে অনির্দিষ্টকালের ক্ষমতা চায় তারা। সেটা সম্ভব কি-না; বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ সরকারকে বিচার করতে পারত পাঁচ বছর পর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যে কয়টি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে, সেই কয়েকটি নির্বাচনে জনগণ মোটামুটি নিজেদের রায় দিয়ে সরকারকে বহাল রাখতে অথবা বিদায় করতে পেরেছেন। সেই পথ বন্ধ গত ১৫ বছরে। ফলে জনগণের কাছে আর যেতে হচ্ছে না সরকারকে। পুলিশ-প্রশাসন-রাষ্ট্রব্যবস্থা দিয়েই সরকার নিজের গদি নিশ্চিত করতে পারছে। তাই জনগণের কথা ভাবা, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা ভাবা, তাদের প্রতি ন্যূনতম সম্মান জ্ঞাপনের প্রবণতা, সবকিছু উধাও। ‘সব ক্ষমতার মালিক জনগণ’- এ কথা কেবল তখনই আংশিক বা পুরো সত্য হতে পারে, যখন জনগণের কাছে যেতে বাধ্য হয় রাজনৈতিক দলগুলো।
বিভাজন-বিভক্তি তাদের দুর্বল করছে, সরকারকে করে দিয়েছে বেনিফিশিয়ারি। সরকারের বিশ্বস্ত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মাঝেমধ্যে এ উপলব্ধির জানান দেয়। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের সম্প্রতি বলেছেন, আওয়ামী লীগই তাদের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হোক, তা কোনো সরকারই চায় না বলেও অভিমত তার। পেয়ে হারানো এবং না পাওয়ার কিছু ক্ষোভ থেকে জিএম কাদের এখন যত কথাই বলুন না কেন, সাইড লাইনেই থাকতে হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে। আওয়ামী লীগই জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে আওয়ামী লীগের প্রয়োজনে। জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব কোনো ধর্তব্যের বিষয় না।
ক্ষমতাসীনরা জাপার ভেতর সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। নির্বাচন যতই কাছাকাছি আসছে, জি এম কাদের ও রওশন এরশাদকে ঘিরে জাতীয় পার্টিতে অভ্যন্তরীণ বিরোধ তত দানা বাঁধছে। দলের কর্র্তৃত্ব, কমিটি গঠন ও প্রার্থিতা নিয়ে দুপক্ষের বিরোধ সামনে আরও চাঙ্গা হওয়ার নমুনা দেখা যাচ্ছে দলটিতে। নির্বাচন কমিশনে দেখানো হিসাবে জাপার আয় ও ব্যয় দুটোই আগের বছরের তুলনায় বাড়লেও দলটির রাজনীতির মূল ধারায় আসার বার্তা দেয় না। বরং শেষ পর্যন্ত দলটির সাইডলাইনই নিশ্চিত হতে পারে। সাইড থেকে আওয়ামী লীগ বা ঘটনা চক্রে বিএনপির সঙ্গেও মিতালি হতে পারে। জামায়াতে ইসলামী এক অর্থে সাইড লাইনেও নেই। আরেক অর্থে ভেতরগতভাবে তারা বেশ নিজস্বতায় বেশ সংগঠিত। দেশি-বিদেশি সংযোগের বরকতে গত ১০ জুন প্রায় ১০ বছর পর অনুমতি নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। এর আগে, পুলিশের অনুমতি নিয়ে ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারা সর্বশেষ বিক্ষোভ মিছিল করেছিল ঢাকার মতিঝিলে। এবার সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া ও বিদেশি বিশেষ লবিংয়ে সাইডলাইন থেকেই রাজনীতির নতুন ব্যাকরণে পড়েছে জামায়াত। বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন মার্কিন ভিসানীতির তাৎক্ষণিক সুফলপ্রাপ্তদের মধ্যে পয়লা নম্বরে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। সেই থেকে জামায়াত আন্দোলন ও ভোটের মাঠে বিএনপির প্রযতেœই থেকেছে। এখন তাদের প্রযত্নের খুঁটিতে হেরফের বেশ আলোচিত।
রাজনীতির সমীকরণে আওয়ামী লীগের কাছে জামায়াতে ইসলামী এখন আর যুদ্ধাপরাধীদের দল নয়। জঙ্গিদের দলও নয়। এ ব্যাকরণে জামায়াতের প্রতি সদয় সরকার। জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের এখন আর কোথাও গোপন বৈঠক থেকে পাকড়াও হতে হয় না। সাইড লাইনে থাকা জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সখ্য নতুন নয়। এরশাদের আমলে ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপির সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চলা আন্দোলনে জামায়াতও ছিল। এমনকি কখনো কখনো সাইডলাইন থেকে মেইন স্ট্রিমে এসে কেয়ারটেকার সরকার তাদেরই আবিষ্কার বলে গর্বও করেছে। এরপরও তাদের সাইড লাইনেই থাকতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আবার বিএনপির জোটসঙ্গী হয়ে ক্ষমতায়ও গেছে। এবার তাদের লাইন এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। যার নেপথ্যে স্থানিক রাজনীতির চেয়ে বিশ্বরাজনীতির মশলার ছিঁটেফোটা সাদা চোখেও বোধগম্য।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
mostofa71@gmail.com