বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০২ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য

শাহাদাৎ হোসাইন:

কৌশলগতভাবে দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দো-প্যাসিফিকের বাকি অংশের মধ্যে একটি সংযোগকারী দেশ হিসেবে, বাংলাদেশ এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক সময়ে বেশ গুরত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি বাংলাদেশ চীনের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরই)-এ স্বেচ্ছায় অংগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিতে নিরপেক্ষতা রয়েছে এবং এটি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা অর্জনের ওপর জোর দিয়েছে। তবে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রভাব বিস্তারের লড়াই বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিকে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক অবস্থা বজায় রাখতে বাধ্য করেছে।

গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক সময়ে ও এর অর্থনীতির একটি চমকপদ অগ্রগতির যুগে বাংলাদেশ এখন ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত একটি প্রভাবশালী বৈশ্বিক দক্ষিণ ব্লক ব্রিকসে যোগদানের দ্বারপ্রান্তে। ব্রিকসে বাংলাদেশের আগ্রহের প্রেক্ষাপটের যথেষ্ট ভূ-রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। এছাড়া এই সিদ্ধান্ত এমন একটি সময়ে হচ্ছে যখন বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার মানবাধিকার ইস্যু এবং বিতর্কিত ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোচ্চার সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। ২০২১ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভিজাত আধাসামরিক বাহিনীকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার ১১০টি দেশ নিয়ে ‘সামিট ফর ডেমোক্রেসি’তে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেননি।

চলতি বছরের মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রচারে’ নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। এই নীতির অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া দুর্বল করার জন্য দায়ী এমন ব্যক্তিদের জন্য ভিসা সীমিত করতে পারে। স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এই নীতি বাংলাদেশের সরকারের বিপক্ষে গেছে এবং বিরোধী দল এর পক্ষে গেছে। ভিসানীতির প্রতিক্রিয়ায়, বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য দাবি করেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাইছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য ভিসানীতিকে এটিকে শাসন-পরিবর্তনের ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। তিনি জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাকে ক্ষমতায় চায় না, তাই তারা ভিসানীতি দিয়েছে।’

অতি সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ডজন অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে একটি উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করা একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলমের ওপর হামলার নিন্দা জানানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতির ব্যাখ্যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের তলব করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ঢাকার পক্ষ থেকে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আসা বিবৃতিকে ‘অকূটনৈতিক মনোভাব’ হিসেবে দেখা হয়েছে।

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ওয়াশিংটন ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে আসছে। ব্রিকসে বাংলাদেশের আগ্রহের ঘোষণা সেই প্রত্যাশাকে ব্যর্থ করে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সমালোচনা করলেও চীন বর্তমান সরকারের প্রতি তার অটল সমর্থন প্রদর্শন করছে। একটি প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান অন্যায্য না হলেও, ঢাকায় চীনের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে মার্কিন উদ্বেগের সমালোচনা করে একটি কলাম লেখার প্রয়োজন মনে করেছেন। সেই সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অজুহাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ তোলেন এবং ‘ক্ষমতার রাজনীতির’ বিরোধিতা করতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার জন্য চীনের প্রস্তুতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

শেখ হাসিনার চলতি মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে আশা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশ এবং আরও কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতি পূর্ণ সদস্যপদ বা পর্যবেক্ষক পদমর্যাদা লাভ করবে। ব্রিকস সম্মেলনের পর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ অতিথি হিসেবে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতেও যাবেন।

বর্তমান আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে, ব্রিকসে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অন্তর্নিহিত প্রত্যাখ্যান হিসেবে দেখা যেতে পারে। এটার ব্যাখ্যা অন্য রকমও হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তারা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্রিকস দেশগুলো বিশেষ করে চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক উপভোগ করছে। ফলে বাংলাদেশের ব্রিকসমুখী কূটনীতি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বর্তমান সরকারের সঙ্গে ব্রিকস দেশগুলোর সঙ্গে সরকারের উষ্ণ সম্পর্কের প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফসল হিসেবে দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের বিরোধী দল বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় আপত্তি তুলেছে এবং নির্বাচনের সময় নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে। তবে সরকার এসব দাবি আমলে নিচ্ছে না।

চীন, জাপান, ভারত এবং রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ বহু বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে নিযুক্ত। এটি অনুমান করা যুক্তিসংগত যে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের অগ্রগতি সরকার পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। ফলে বিশ্বের অনেক বড় বড় শক্তি বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাম্প্রতিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনগুলো ভূ-রাজনীতির পরিস্থিতিতে ভূমিকা রেখেছিল। একইভাবে, ২০১৮ সালে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মালদ্বীপের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিবৃতি পাল্টা বিবৃতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। বিরোধীদের দাবি পূরণে অস্বীকৃতি এবং বিগত দুটি নির্বাচনকে ঘিরে এত বিতর্কের মধ্যে, আসন্ন নির্বাচনে সরকার আরও সমালোচনা এড়াতে পারবে বলে মনে হয় না।

লেখক : রিসার্চ স্কলার, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি,নিউ দিল্লি, ভারত

shahadatju44@gmail.com

ভয়েস/আআ/দেশরূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION