বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০২ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ভুল শোধরাতে ভুল নয়

মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
শরিয়তের দৃষ্টিতে ভুল একটি স্বাভাবিক বিষয়। এক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা হলো, একজন মুমিনের ভুল সংশোধন করে দেবে অপর একজন মুমিন, যা গুরুত্বের সঙ্গে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামের বিধানে ভুল শোধরানোর নীতিমালা রয়েছে। এই নীতি অবলম্বন না করায় হিতে বিপরীত হয়। সম্পর্কে ফাটল ধরে, বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই, সুতরাং তোমরা ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।’ -সুরা আল হুজরাত : ১০

বর্ণিত আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ভুল সংশোধন করে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক দৃঢ় করার উপায় বাতলে দিয়েছেন। নবী কারিম (সা.) ভুল সংশোধনের ক্ষেত্রে অনন্য নজির রেখে গেছেন। ভুল শোধরানোর ক্ষেত্রে কখনো তিনি প্রশ্ন করেছেন, আবার কখনো উপমা দ্বারা ভুল বুঝিয়ে দিয়েছেন, কখনো ইশারা-ইঙ্গিতে ভুলকারীকে সংশোধন করেছেন, আবার কখনো রাগও করেছেন। এভাবে তিনি ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে সংশোধন করেছেন।

অনেকেই ভুল শোধরাতে তিরস্কারের পথ অবলম্বন করেন। এটা কোনো কার্যকর পথ নয়, কারণ তিরস্কার কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। এ জন্য তিরস্কার পরিহার করে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেওয়াটাই অধিক শক্তিশালী ও কল্যাণকর। হজরত আবু উমামা (রা.) বলেন, এক যুবক রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন। এটা শুনে লোকজন তার প্রতি উত্তেজিত হয়ে ধমক দিল এবং চুপ করতে বলল। তখন রাসুল (সা.) তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, বসো। যুবকটি বসার পর হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বলেন, তুমি কি এটা তোমার মায়ের জন্য পছন্দ করো? যুবক জবাব দিল, আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ, তা কখনো পছন্দ করি না। তখন রাসুল (সা.) বললেন, তেমনি মানুষও তাদের মায়েদের জন্য সেটা পছন্দ করে না। তারপর রাসুল (সা.) বললেন, তুমি কি তোমার মেয়ের জন্য তা পছন্দ করো? যুবক জবাব দিল, আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ, তা কখনো পছন্দ করি না। তখন রাসুল (সা.) বললেন, অনুরূপভাবে মানুষ তাদের মেয়েদের জন্য সেটা পছন্দ করে না। তারপর রাসুল (সা.) বললেন, তুমি কি তোমার বোনের জন্য সেটা পছন্দ করো? যুবক জবাব দিল, আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ, তা কখনো পছন্দ করি না। তখন রাসুল (সা.) বললেন, তদ্রƒপ লোকেরাও তাদের বোনের জন্য তা পছন্দ করে না। (এভাবে রাসুল (সা.) তার ফুফু, খালা সম্পর্কেও অনুরূপ কথা বলেন আর যুবকটি একই জবাব দিল)। এরপর রাসুল (সা.) তার বুকে হাত রেখে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তার গোনাহ ক্ষমা করে দিন, তার মনকে পবিত্র করুন এবং তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করুন।’ বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, এরপর এ যুবককে কারও প্রতি তাকাতে দেখা যেত না। -শোয়াবুল ইমান : ৫৪১৫

ভুল শোধরানোর ক্ষেত্রে সর্বদা নরম ভাষায় বোঝানো ও রাগের সময় ভুল শোধরাতে না যাওয়া। ইসলামি স্কলাররা বলেন, ভুল সংশোধন করে দেওয়ার পরে তাকে সঠিক পথ সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিন, যাতে তার সামনের দিনে পথচলা সহজ হয়। আর সব ভুল সংশোধন করা নিজের ঘাড়ে না নেওয়া। বরং যেটা সাধ্যের বাইরে সেটা অন্যের জন্য ছেড়ে দেওয়া। ‘সব ভুল সংশোধন নিজের কাঁধে বা ঘাড়ে না নেওয়া’র বিষয়টি নিয়ে একটু পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, ভুল শোধরানোর ক্ষেত্রে অনেকের এমন মনোভাব হিতে বিপরীত হচ্ছে। অনেকেই অন্যের ভুল সংশোধন করতে চান, এটা অবশ্যই ভালো উদ্দেশ্য, মহৎ কাজ ও চিন্তা। দয়াময় আল্লাহ তো এমন কাজ করতে বলেছেন যে, ‘তোমরা পরস্পরে পুণ্য ও তাকওয়ার কাজে সাহায্য করো।’ -সুরা আল মায়িদা : ২

তাহলে একজন মানুষ পাপকাজে নিমজ্জিত ও ভুলে জর্জরিত, যা নিঃসন্দেহে পাপ। আমি তাকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য যে কাজ করছি তা তো নিশ্চিত পুণ্য ও তাকওয়ার কাজে সাহায্যেরই শামিল। তাহলে এতে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা হলো পদ্ধতিতে। আমরা আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করতে চাই কিন্তু নিজ পদ্ধতিতে। তাহলে কীভাবে সম্ভব? দেখুন, আল্লাহতায়ালা ওই একই আয়াতের পরবর্তী অংশে কতই না সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘তবে পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পকে সহযোগিতা কোরো না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।’ -সুরা মায়িদা : ২

যে আয়াতে আল্লাহতায়ালা এত সুন্দর করে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাহায্য করতে বললেন, আবার ওই একই আয়াতে আল্লাহ পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সাহায্য করতে নিষেধের পাশাপাশি শাস্তির কথা কেন আলোচনা করলেন? ইসলামি স্কলাররা বলেন, একটি উত্তম কাজ (ভুল সংশোধন) করতে গিয়ে মানুষ এমন কিছু কাজ করে ফেলে, যা সীমা অতিক্রম করে ফেলে। আর এই সীমালঙ্ঘনের কারণেই ভুলকারী সংশোধনের পরিবর্তে জেদের বশবর্তী হয়ে আরও ভুল করতে থাকে, ফলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট হওয়ার পরিবর্তে সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হয়।

কোনো পরিচিতজন কিংবা মুমিন-মুসলমানকে ভালো পরামর্শ এবং কোনো ভুল দেখতে পেলে তা সংশোধন করে দেওয়ার অধিকার ইসলাম অবশ্যই আপনাকে দিয়েছে। কোনো মতামতের সঙ্গে যদি সবার মতামত না মেলে, তাহলে ওই মতামতের বিপরীতে অন্যের মতামত ব্যক্ত করার অধিকারও ইসলাম দিয়েছে। তবে পরামর্শ দেওয়ার নামে, ভুল ধরিয়ে দেওয়ার নামে, সংশোধনের নামে, মতামত ব্যক্ত করার নামে যদি অন্যকে আক্রমণ করেন, ছোট করেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, গালাগালি করেন, ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন- তাহলে অবশ্যই এর জন্য আপনাকে গোনাহগার হতে হবে, আপনি নিন্দিত হবেন। আর যদি ভুলকারীকে আক্রমণ না করে, ছোট না করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে, গালাগালি না করে, সম্মান রক্ষা করে সুন্দর ভাষায়, আন্তরিকতা রেখে ভুল ধরিয়ে সংশোধন করে দেন, ভালো কোনো পরামর্শ দেন, তাহলে অবশ্যই এর জন্য নেকি পাবেন, প্রশংসিত হবেন। এবার সিদ্ধান্ত নিন, ভুল শোধরাতে কোনটি কার্যকর পন্থা এবং কোনটি গ্রহণ করা উচিত।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক

muftianaet@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION