বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:০৫ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
তাহাজ্জুদ নামাজ ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে তা নিয়মিত আদায় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। ফরজ নামাজের পর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নামাজ হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাজ। পুরো পৃথিবী যখন নীরবতার কোলে হারিয়ে যায়, মহান আল্লাহ তখন নেমে আসেন নিকটবর্তী আসমানে, বান্দার খুব কাছাকাছি। কার কী প্রয়োজন, কী আকাক্সক্ষা, কী ফরিয়াদ, বারবার জানতে চান তিনি। রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহ বান্দাদের প্রতি তাদের কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান। বান্দাদের প্রয়োজন পূরণের কথা শোনেন। তাহাজ্জুদের মাধ্যমে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়, বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও নৈকট্য লাভ করেন। এতে মুমিনের আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
তাহাজ্জুদ ইসলামের প্রথম দিকে ফরজ ছিল। অনেক দিন পর্যন্ত তা ফরজই ছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী! রাতের বেলা নামাজে রত থাকো। অর্ধেক রাত, কিংবা তার চেয়ে কিছু কম করো। তবে কিছু সময় ছাড়া অথবা তার ওপর কিছু বাড়িয়ে নাও। আর কোরআন থেমে থেমে পাঠ করো। আমি অতি শিগগির তোমার ওপর একটি গুরুভার বাণী নাজিল করব। নিশ্চয়ই রাতের বেলা জেগে ওঠা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেশি কার্যকর এবং যথাযথভাবে কোরআন পড়ার জন্য উপযুক্ত সময়।’-সুরা মুজজাম্মিল : ১-৬
পরে তাহাজ্জুদ নামাজ নফল হিসেবে সাব্যস্ত হলে মহান আল্লাহ তার প্রিয় রাসুল (সা.)-কে বলেন, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করবে। এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত। নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রশংসিত স্থানে ওঠাবেন।’ -সুরা ইসরা : ৭৯
হাদিসে এসেছে, হজরত সাদ ইবনে হিশাম (রহ.) বলেন, আমি বললাম! হে উম্মুল মুমিনিন! আপনি আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র বিষয়ে কিছু বলুন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, তুমি কি কোরআন পড়ো না? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র কোরআনে যা আছে তাই। তারপর সাদ বলেন, আপনি আমাকে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রাতের নামাজের ব্যাপারে বলুন। তখন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, তুমি কি ইয়া আইয়্যুহাল মুজজাম্মিল পড়ো না? সাদ বলেন, আমি বললাম, হ্যাঁ আমি পড়ি তো। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এ সুরার যখন প্রথমাংশ নাজিল হয়, (যাতে তাহাজ্জুদ ফরজ হয়) তখন সাহাবায়ে কেরাম এত দীর্ঘ তাহাজ্জুদ পড়তেন যে, তাদের পা ফুলে যেত। আর এ সুরার শেষাংশ বারো মাস পর্যন্ত আসমানে আটকে থাকে। বারো মাস পর যখন এর শেষাংশ নাজিল হয়, তখন যে তাহাজ্জুদ ফরজ ছিল তা নফল হয়ে যায়।’-সুনানে আবু দাউদ : ১৩৪৪
তাহাজ্জুদ আদায়কারী বান্দাদের জন্য আল্লাহ জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন। হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই জান্নাতের মধ্যে এমন কতিপয় সুন্দর প্রাসাদ রয়েছে, যার বাইরের দৃশ্যগুলো ভেতর থেকে দেখা যায় এবং ভেতরের দৃশ্যগুলো বাহির থেকে দেখা যায়। এক বেদুইন দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এ প্রাসাদগুলো কার জন্য?’ তিনি বললেন, যার কথা নরম। ক্ষুধার্তকে খাদ্য প্রদান করে। নিয়মিত নফল রোজা পালন করে এবং রাতের বেলা মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সে নামাজ আদায় করে।’ -জামে তিরমিজি : ১৯৮৪
নবী কারিম (সা.)-এর পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তার পরও তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। দীর্ঘ নামাজের কারণে নবীজির পা ফুলে যেত। সহিহ সনদে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত মুগিরা ইবনে শোবা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (নবী কারিম) রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত বেশি নামাজ আদায় করতেন যে, তার পা মোবারক ফুলে যেত। এটা দেখে তিনি (হজরত আয়েশা রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এত কষ্ট করছেন, অথচ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে! হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমার কি উচিত নয় যে, (এ মহা অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে) আমি একজন পূর্ণ কৃতজ্ঞতা আদায়কারী বান্দা হব?’ -সহিহ বোখারি : ১০৭৮
গভীর রাতে সবাই যখন আরামের নিদ্রায় মশগুল, মুমিন তখন আরামের নিদ্রা ত্যাগ করে রবের সান্নিধ্য লাভের জন্য নামাজে দন্ডায়মান হয় তখন স্বয়ং আল্লাহ তার বান্দার নিকটবর্তী হন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রাতের শেষভাগে রব তার বান্দার খুব নিকটবর্তী হন। যদি পারো, ওই সময় আল্লাহর জিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও!’ -জামে তিরমিজি : ৩৫৭৯
যেহেতু তাহাজ্জুদের নামাজ রাতে ঘুম থেকে উঠে আদায় করতে হয়, অনেকের জন্য তা কষ্টকর। কিন্তু কেউ যদি রাতে ঘুমানোর সময় নিয়ত করে ঘুমায় এবং কোনো কারণে তার তাহাজ্জুদের নামাজ ছুটে যায়, তাহলেও সে সওয়াব পাবে। এ জন্য তার প্রথম কাজ হলো, পাকাপোক্ত নিয়ত করা। অন্তর থেকে নিয়ত করতে পারলে আমল সহজ হয়ে যায়। বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমলসমূহেরই যে শুদ্ধাশুদ্ধির বিচার হয়, কেবল তা নয় অনেক সময় ওজরবশত উক্ত আমল করতে না পারলেও আমলের সওয়াব পেয়ে যায় মুমিন। বিষয়টি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে এভাবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে আদায় করার নিয়ত করে বিছানায় গেল, কিন্তু ঘুম তাকে পরাস্ত করল, সে উঠতে পারল না, এমনকি সকাল হয়ে গেল, তাহলে নিয়তের কারণে তার আমলনামায় আমলের সওয়াব লেখা হবে। আর এই ঘুম রবের পক্ষ থেকে তার জন্য সদাকা বলে বিবেচিত হবে।’-সুনানে নাসাঈ : ১৭৮৭
প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তিই কামনা করেন, আল্লাহ যেন তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন, ইবাদত-বন্দেগি কবুল করেন এবং ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেন। এসব চাওয়া-পাওয়ার প্রধান অবলম্বন হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। তাহাজ্জুদ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একান্ত কথোপকথনের মহান অবলম্বন। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। তাহাজ্জুদের বদৌলতে মানুষ মহান মর্যাদার অধিকারী হয়। মুমিনদের উচিত, তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নফল নামাজের আমল অব্যাহত রাখা। সেই সঙ্গে আল্লাহর দরবারে কাতর কণ্ঠে দোয়া করা নিজ ও পারিবারিক যাবতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য, আপনজনের মধ্যে যারা ইন্তেকাল করেছেন- তাদের মাগফিরাতের জন্য।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com
ভয়েস/আআ