সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৭:৩১ পূর্বাহ্ন
মাছুম বিল্লাহ:
এ দেশে যখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছিল তখন প্রায় এক-চতুর্থাংশ নাগরিককে না খেয়ে ঘুমাতে যেতে হতো, এখন সতেরো কোটি মানুষ কিন্তু আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি। এই বিপ্লব ঘটিয়েছেন আমাদের কৃষি কর্মকর্তা, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি গবেষকরা এবং কৃষিসংশ্লিষ্ট সবাই। তারা নীরবেই কাজ করছেন। তাদের আমরা কোনোভাবেই লাইমলাইটে নিয়ে আসি না, চিন্তাও করি না। একটি জেলায় কৃষির সঙ্গে যারা জড়িত তারা এক বছরে কী কী করলেন, কী আবিষ্কার করলেন, নতুনভাবে কী করেছেন সেই বিষয়গুলো, সেই গল্পগুলো সবার শোনা উচিত। তাহলে কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি কর্মকর্তাসহ সবাই উৎসাহী হবেন। দেশও মারাত্মকভাবে উপকৃত হবে।
আমরা সর্বদাই নাম শুনি, সর্বোচ্চ পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে থাকি ডিসি ও এসপিকে। কারণ এখানে ক্ষমতার বিষয়। সবকিছু ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। ডিসি প্রশাসনের লোক, এসপি পুলিশের লোক। প্রায় তিনশ বছর আগে ব্রিটিশ এই পাক-ভারত উপমহাদেশ শাসন করতে এসে এই পদ্ধতি সৃষ্টি করে গেছে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিশ সুপার তারা সবাই ছিলেন সেই সাদা চামড়ার। তাদের প্রবর্তিত সেই পদ্ধতি এত শত বছর পরও বাদ দেওয়া তো দূরের কথা বরং অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চলেছি। নির্ভর করছি এই দুই উইংয়ের ওপর। সেটি উপজেলা থেকে শুরু করে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত। ছেলের বিয়ে, মেয়ের বিয়ে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব যদি এই দুই ক্যাডারের লোক হয় তাহলে গলার স্বর বড় করে বলি। আর তাই, কৃষি বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করে পুলিশ হচ্ছেন, মেডিকেল পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন, বুয়েট থেকে পাস করে হয় পুলিশ কিংবা প্রশাসন ক্যাডারে যাচ্ছেন। যাবেনই তো! এতে দেশ কী পাচ্ছে বা না পাচ্ছে সেদিকে করুরই যেন কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। ব্রিটিশরা এই দুই ধরনের কর্মকর্তা বানিয়েছিলেন। আমরা দু’দুবার স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু মানুষের মুক্তি আনতে পারিনি বরং ব্রিটিশের চেয়েও ভয়ংকররূপে, পাকিস্তানিদের চেয়েও ভয়ংকররূপে আমরা তৈরি করেছি এই দুই পেশার কর্মকর্তাদের। এখানেই যেন ক্রেডিট! মাঝেমধ্যে মনে হয় ব্রিটিশের সূর্য কিন্তু আসলেই অস্ত যায়নি বরং আরও শক্তিশালীরূপে আমাদের এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ জন্য এককভাবে কোনো ব্যক্তি, কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো সরকার দায়ী নয়। দায়ী আমরা সবাই। মানুষ দেশের কাছে কী চায়, একটি দেশ তার নাগরিকদের কাছে কী চায় সেই হিসাব ও চাওয়া-পাওয়াতেই ভুল। তা না হলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পাস করে কীভাবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা (এমন নয় যে, তিনি দাঙ্গা পুলিশের একজন সদস্য) যেকোনো ছাত্র আন্দোলনকে ব্রিটিশের চেয়েও কঠিনরূপে, পাকিস্তানিদের চেয়েও কঠিনভাবে লাঠি আর অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার করে দমনপীড়ন চালায় আর রাষ্ট্র থেকে বাহবা পায়? বলছি সদ্য ঘটে যাওয়া একজন এডিসির কথা। এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে সর্বত্র। যেহেতু ক্ষমতার খেলা তাই সবাই ওই রকমের দাপুটে পুলিশ হতে চায়। কী সমাজ তৈরি করেছি আমরা! কী শিক্ষা দিচ্ছি আর শিক্ষার কী প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি?
সিস্টেমটাকে আমরা পাল্টাতে পারলাম না! আমরা সবাই জানি থানা হোক আর এসপি অফিস সব জায়গাতেই চলে ক্ষমতা আর অর্থের খেলা, যেখানে সাধারণ মানুষের কোনো প্রবেশাধিকার নেই (খাতায় বা মুখে মুখে অবশ্য আছে)। আপনার অর্থ আছে আপনি সবকিছ ম্যানেজ করে ফেলতে পারবেন। আপনার আর্থিক অবস্থা যাই হোক বিপদে পড়লে আপনাকে এসব জায়গায় টাকা ঢালতে হবে। ক্ষমতা আর অর্থের কারণেই যে চাকরিপ্রার্থীদের কাছে পুলিশ বিভাগ পছন্দের শীর্ষে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সম্প্রতি একটি ঘটনায় জড়িয়ে পুলিশ, প্রশাসন ক্যাডার আর ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম হয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে পুলিশের রমনা বিভাগের এডিসি (সাসপেন্ড) হারুন-অর-রশীদ ও আরেক সরকারি কর্মকর্তা আজিজুল হক মামুনের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আরেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং আজিজুল হক মামুনের স্ত্রী সানজিদা আফরিনকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটে। এর জেরে কেন্দ্রীয় দুই ছাত্রলীগ নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ ওঠে। আলোচিত এ ঘটনায় এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) মোস্তফাকে বদলি করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ‘ব্যক্তিগত’ ঘটনার জের ধরে পুলিশি ক্ষমতা ব্যবহার করে অধস্তনদের মাধ্যমে তিন ছাত্রলীগ নেতাকে শাহবাগ থানায় ধরে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়েছেন। এক্ষেত্রে কেবল ক্ষমতার অপব্যবহার নয়, তিনি ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। অন্যদিকে যে ‘ব্যক্তিগত’ ঘটনার জের ধরে এই কা-, তাতে করে এডিসি হারুনের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। পাশাপাশি, এ ঘটনায় পুলিশ, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কেউই কিন্তু আইনের আশ্রয় নেননি বরং রাষ্ট্রীয় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিয়েছেন।
আমরা জানি ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, বিরোধী দলের সদস্যসহ যারা কোনো পাবলিক ইস্যু নিয়ে কথা বলতে রাস্তায় নেমেছেন, ইংরেজি সাহিত্য পড়া ওই এডিসি সবাইকেই পিটিয়েছেন এবং বাহবা কুড়িয়েছেন। তার মাত্রাতিরিক্ত এবং অনিয়মতান্ত্রিক বলপ্রয়োগের বিষয়টি সরকার বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আনা হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নাগরিকদের আস্থা অর্জনের জন্য পুলিশে সংস্কার আনার কথা আমরা বারবার শুনেছি কিন্তু তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা নাঈম ও মুনিমকে শাহবাগ থানায় বেধড়ক পেটানো, দাঁত উপরে ফেলার ঘটনায় বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশ প্রশাসন, সরকারি দল ও সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গণমাধ্যমের কিছু রিপোর্ট বলছে যে, সবাই মারামারি ও হাতাহাতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কারণ সর্বত্রই তো পাওয়ারের খেলা! এখানে তিন পক্ষই দায়ী! কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে কেউ-ই কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিচার বা বিচারের পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাননি। রাষ্ট্রপতির এপিএস ও প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় আইন না মেনে অন্যপথে বিচার করতে চেয়েছেন, পুলিশ রাষ্ট্রীয় পোশাক পরে আইনের বিরোধী কাজ করেছেন। ঢাবির ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ভবিষ্যতে যারা জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে নেতৃত্ব দেবেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ছাত্রলীগকেই পুলিশের চেয়ে শক্তিশালী মনে করেছেন। পুরো ঘটনাটি রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য অশনিসংকেত। এখানে তিন পক্ষই কিন্তু পেশিশক্তি প্রদর্শন করতে চেয়েছেন, যা আইনসংগত নয়।
লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
masumbillah65@gmail.com