সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৭:৫০ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

দাঁড়ালেই দন্ড

মামুনুর রশীদ:
ছুটির দিন নয়, এমনি একটা দিনে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হলাম সকাল ১০টার দিকে। ধারণা করলাম টাঙ্গাইল যেতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। কারণ ঢাকা-টাঙ্গাইলের পথে পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। শুধু পাঁচ ঘণ্টা নয়, আট ঘণ্টার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু যে জায়গাটা খুবই জটিলতাপূর্ণ সেই গাবতলী গিয়ে দেখলাম রাস্তা ফাঁকা আর কয়েকটি সাইনবোর্ড যেখানে লেখা ‘দাঁড়ালেই দন্ড’। খুবই নির্বিঘ্নে আমিন বাজার সেতু পার হয়ে গেলাম। ভাবলাম এর পরের জায়গাটা হচ্ছে সাভার বাসস্ট্যান্ড। ওখানে ঘণ্টাখানেক লাগবেই। কিন্তু রহস্যজনকভাবে দেখলাম সেখানেও একই সাইনবোর্ড ‘দাঁড়ালেই দন্ড’ এবং রাস্তা ফাঁকা। গেলাম নবীনগর সেখানেও একই অবস্থা, রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি চলছে কোথাও কোনো বাধা নেই। তিন ঘণ্টার মাথায় আমি টাঙ্গাইলের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। কী করে সম্ভব হলো! হঠাৎ মনে পড়ল এ হচ্ছে সদ্য নির্বাচিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র বন্ধুবর আনিসুল হক এবং প্রিয়ভাজন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের পদক্ষেপ।

এরপর ঈদের ছুটিতে টাঙ্গাইল যেতে খুব কষ্টভোগ করেছি। কিন্তু একবার ড্রাইভার জানাল, স্যার কালকে টাঙ্গাইল যেতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোনো ম্যাজিক হচ্ছে কি? ড্রাইভার বলল, হ্যাঁ, হচ্ছে। কালকে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বসবেন এবং তিনি সারা দেশের ট্রাফিক সিস্টেমের পরিস্থিতি দেখবেন। সত্যিকারের ম্যাজিক ঘটে গেল। ঈদের আগের দিন আড়াই ঘণ্টার মধ্যে মায়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। এই ঘটনাগুলোতে কি মনে হয়? আমরা পারি। শুধু প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটু হাল ধরা। কখনো হাল ধরেন মেয়র আনিসুল হক, কখনো জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান। কখনো বড় ধরনের সংকটে হাল ধরেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যথায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কিন্তু সমগ্র ব্যবস্থাটাকে একটা নিয়ন্ত্রণে আনা কি সম্ভব নয়? প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নতির ফলে এটা তো কোনো বিষয়ই নয়। কেমন করে বিষয় নয় তাও জানি।

প্রাচ্যদেশীয় লোকগুলো বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষ আইন মানতে চায় না। আইনের ব্যাপারে তাদের এক ধরনের ক্ষোভ আছে। কেন আইন মানব? এই জন্যই লাখ লাখ মামলার স্তূপ জমে ওঠে আদালতগুলোতে। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে জেলা শহরগুলোতে আদালতের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। এখন সেখানে ছয়তলা থেকে আটতলা পর্যন্ত ভবনে বিভিন্ন আদালত গড়ে তোলা হয়েছে। একটি জেলা শহরেও অনেক বিচারক রাখতে হচ্ছে এবং ছয় সাত এমনকি আটতলা ভবন নির্মাণ করতে হচ্ছে শুধু আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। দেশের স্বাধীনতা কি শুধু আদালত নির্মাণের কাজ করবে না কি মানুষে মানুষে সংঘাত কমিয়ে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনকারীর সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসবে?

আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখতাম একটা লোক ছোট্ট একটা গাড়ি চালিয়ে চলাচল করত। পাঁচ-ছয় গজ দূরের একটা জায়গায় যেতেন। একটু বড় হয়ে জেনেছি তিনি জেলার মুন্সেফ। বাসা থেকে আদালতে যান। তার চেহারা কখনো দেখিনি। কিন্তু একটা ছোট্ট এলাকায় তিনি এসব আইন আদালতের বিচার করেন। আর বাকিটা করেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। সেটাও খুব বড় কিছু নয়।

সম্প্রতি ব্যাংকের একজন ডিজিএমের স্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের একজন অফিসারের দ্বন্দ্ব হয়েছে। কারণ উনি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে গাড়ি পার্ক করেছিলেন। কিন্তু ডিজিএমের স্ত্রী বলছেন তিনি আইন ভঙ্গ করেননি। তার নামতে যতটুকু সময় লেগেছে ততটুকু সময়ই তিনি নিয়েছেন। এসব ব্যাপারে অনেক বাহাস হতে পারে, কে ভুল আর কে ঠিক? কিন্তু ট্রাফিক আইন তো মানতে হবে। যেখানে ট্রাফিক আইন সম্পূর্ণভাবে যন্ত্র বিবর্জিত আধুনিককালে সমস্ত ব্যবস্থা উপেক্ষিত, যে শহরে সবুজ, হলুদ এবং লালবাতির সংকেত জ¦লে না সেই শহরে ট্রাফিক আইন কী করে বাস্তবায়ন করা যায়? অধিকাংশ সময়ে হস্ত নির্দেশিত ট্রাফিক সিগন্যাল দেখা যায় অথবা নির্দেশকারী একেবারেই তার অভিজ্ঞতাপ্রসূত ট্রাফিক সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছেন। তখন তা মেনে চলাও কি নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকাবাসী এই যে আদিম অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে তার জন্য তাদের কোনো আক্ষেপ নেই?

স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যেটা ছিল আমাদের একটা আদর্শ ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থাকে কেমন করে ধ্বংস করা হলো তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। স্কুলের ওই শিশুরা মন্ত্রীদের, পুলিশ অফিসারদের হাঁটতে বাধ্য করেছিল। তারা ওই ব্যবস্থাকে কিন্তু মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়ায়।

দেশের রাজনীতিবিদদের কি করে বোঝাব সব কিছু রাজনৈতিক করবেন না! সব কিছুকে রাজনৈতিক করতে গেলে অনেক বড় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। দয়া করে শিক্ষাকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। দুর্নীতিকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। শিক্ষাকে রাজনীতি করতে গেলে কীভাবে দুর্নীতি এসে যায় সেটা আপনারা জানেন। তদবিরে নিয়োগ বাণিজ্যের লাখ লাখ টাকায় শুধু কিছু অশিক্ষিত লোকরা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরি পেয়ে তারা শিশুদের মননকে যে কীভাবে ধ্বংস করে দেয় তা রাজনীতিকরা একটিবারও ভাবেন না।

ঢাকা শহরের নাগরিকরা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে তেমন কিছু বলেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও কিছু বলেন না। প্রথমটায় বলেন না তার কারণ রিকশায় চড়তে তারা খুবই আনন্দ পান এবং অনেক শিক্ষিত লোককে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে রিকশায় করে রাস্তার রংসাইড দিয়ে ঢুকে পড়েন তারা রিকশাচালককে মানা তো করেনই না, অনেক সময় উৎসাহ এমনকি রংসাইডে ঢুকে পড়ার পরামর্শও দেন। আমি এই প্রসঙ্গে তেমন বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ শহরগুলোতে গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক দূর হেঁটে এসে তারা যে গণপরিবহনে চড়ার একটা সুবন্দোবস্ত পাবেন, সেই ব্যবস্থা আমরা রাখতে পারিনি। পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় শহরে নাগরিকদের অনেক পথ হাঁটতে হয়। কারণ তারা গণপরিবহনে উঠবেন হেঁটেই, কাজেই তাদের স্বাস্থ্যও অত্যন্ত ভালো থাকে। এ দেশেও হয়তো রিকশা বন্ধ করে দিলে মধ্যবিত্তদের একটা আন্দোলনও শুরু হয়ে যাবে। যার নাম হবে অলস বাঙালিদের আন্দোলন।

কিন্তু আবার এও দেখেছি, উত্তরা বা মিরপুরের নাগরিকরা খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্রেনে উঠছেন। কিন্তু ধানম-িবাসীর কী হবে? এখানে তো গণপরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই, একমাত্র বাসই ভরসা। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একই ব্যবস্থা। তাদের জন্যও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব সমস্যা মিলে রাষ্ট্রের বায়ান্ন বছর হয়ে গেল, কোনো সুশৃঙ্খল আধুনিক গণপরিবহনের ব্যবস্থা হলো না। অতএব যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে আমাদের নগরগুলোতে সামান্য বৃষ্টি হলে ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় পানি জমে যায়। সেখানে তখন মানুষ মারা পড়বে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এটার কোনো দায়দায়িত্বও নেবে না? দুটি সিটি করপোরেশন নিবিড় ঘুমে রাত্রিযাপন করবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে একটি মন্ত্রণালয় আছে। তারা বৃষ্টিতে ঘুম উপভোগ করবে আর মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বিপদসঙ্কুল সময় অতিক্রম করবে। এসব সমস্যা দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু এর যে সমাধান সম্ভব তা কিন্তু অনেকেই জানেন না। আনিসুল হক জানতেন। ঢাকার বর্তমান মেট্রোপলিটন কমিশনার হাবিবুর রহমান জানেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জানেন। জানেন অনেক নাগরিক। কিন্তু সমস্যা সমাধানের সুযোগ অত্যন্ত কম। তাদের ক্ষমতা যদি বাড়ানো যায় তাহলে অনেক কিছু ঘটানো সম্ভব। সেই দিকটায় আমরা কি যেতে পারি?

লেখক: নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট

mamunur530@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION