সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন
উম্মে রায়হানা:
ছোটবেলা থেকে আমরা একটা কবিতা শুনে বড় হয়েছি। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর লেখা ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ শিরোনামের কবিতাটির লাইনগুলো এরকম, ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি…/ তিনি বলতেন, যে কবিতা শুনতে জানে না সে ভালবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না/ তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল, কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন’। তো এই কবিতা শুনে আমি অনেকবার একজন কবিতাপ্রেমী শ্রমিকের পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত কল্পনা করতে চেষ্টা করেছি। এতদিনে মিডিয়ার কল্যাণে একজন কবির পিঠের ক্ষত দেখতে পেলাম। হ্যাঁ, রক্তজবার মতো ক্ষত বোধহয় একেই বলা যায়, ক্ষতের শেইপ বা সাইজ নয়, রঙটা রক্তজবার মতোই, টকটকে লালই বটে।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ৮০ বছর বয়সী কবি রাধাপদ রায়ের ওপর ভয়াবহ হামলা হয়েছে। এ হামলার প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছেন ২৫ বিশিষ্টজন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে সংস্কৃতিকর্মীদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে কোনো একটি মহলের ইন্ধন বা প্ররোচনায়। একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচার চেয়ে নিন্দা জানিয়ে সরব রয়েছেন নেটিজেনরাও। এই ঘটনায় মামলা হলেও এখনো পর্যন্ত কারও গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাইনি, যদিও অভিযুক্ত মাত্র দুজন এবং তারাও পরিচিতই। হামলা, মামলা, বিচার, শাস্তি ইত্যাদি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে কথা বলবার কিছু নেই সম্ভবত। অনেক বড় বড় ক্রাইমের বিচার আমরা এখনো পাইনি। ত্বকী, তনু, সাগর-রুনি কারও হত্যার বিচার হয়নি, আর এ তো মামুলি মারধরের মামলা। কবিকে জানে মেরে তো ফেলেনি!
খবরের কাগজ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মিলিয়ে যে সব তথ্য পাওয়া গেল তাতে এই হামলার পেছনে কারণ বলে যা যা ধারণা করা হচ্ছে, তার মধ্যে আছে পূর্বের কথা কাটাকাটি, গান-বাজনা বিরোধিতা এবং কবি রাধাপদর ধর্মীয় পরিচয়। গ্রামদেশে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে শত্রুতার জের ধরে সালিশ এবং সালিশের রায় অপছন্দ হলে খুনখারাবিও হয়। যে কবি আশি বছর বয়সেও মুখে মুখে গান বেঁধে লোককে আনন্দ দিয়ে অর্থ উপার্জন করেন তার ভিটেমাটির বাইরে আর তেমন কোনো বিষয়-সম্পত্তি আছে বলে মনে হয় না। গান-বাজনা অপছন্দ করে ‘হিন্দু কবিকে মারলে কিছু হয় না’ ধরনের ফ্যানাটিক আচরণও একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা আরও সংগঠিত হয়। একই পরিবারের দুই ভাই অভিযুক্ত বা আসামি। তাদের পেছনে কোনো সংগঠন আছে বলে তো সাদা চোখে মনে হচ্ছে না। যদিও তাদের সঙ্গে কবির টাকা-পয়সা সংক্রান্ত একটি বিরোধের ইতিহাস রয়েছে।
বাংলাদেশে এর আগে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে কবি মোহাম্মদ রফিককে কারাবরণ করতে হয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘সব শালা কবি হবে/ পিঁপড়েও গোঁ ধরেছে উড়বেই/ দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই।’ এই কবিতা ছিল তৎকালীন সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট এরশাদের প্রতি সরাসরি আক্রমণ। এ ছাড়া কবি দাউদ হায়দার এবং কবি তসলিমা নাসরিনকে বরণ করতে হয় নির্বাসন। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বা শাসক শ্রেণির ক্ষোভের কারণও তাদের লেখা বাণী, কবিতা, কথা। এই দুজনকেই নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী ঘোষণা করেই দেওয়া হয় নির্বাসন।
সাম্প্রতিক সময়ে বাউলদের ওপর হামলা, পা-ুলিপি পোড়ানো, বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলার মতো ঘটনাও অবশ্য ঘটেছে। এমনকি এর আগে একবার বাউলদের চুল কেটে দেওয়ার মতো বর্বর ঘটনাও ঘটেছিল এই দেশের মাটিতে। সে সমস্ত ঘটনাকে সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসেবে দেখার সুযোগও রয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে রাধাপদ রায়ের ওপর হামলার কারণও সম্ভবত তার বাণীই, কেবল ধর্মীয় পরিচয় বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নয়। ধর্মটাকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে হামলাকারীরা।
রাধাপদ রায় লিখেছেন-
“সরকারি চাকরি করে বেতন ৫ হাজার
৫০ হাজার টাকা মাসে খরচ দেখি তার
বাকি টাকা কেমনে আসে, সেই কথা আর বলি না
কেয়ামতের নমুনা জানি, কিন্তু মানি না।”
তার এই লেখা প্রশাসন ও ক্ষমতা কাঠামোতে থাকা দুর্নীতি ও অসততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, এই কবিতার আরও অংশ আছে যেখানে তিনি ভেজাল পণ্য, জ্বালানি, পরিবেশ ও নদীদূষণ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি যেহেতু স্বভাবকবি, এলাকায় চারণকবি হিসেবে পরিচিত, গ্রামের মানুষের কাছে তার কবিতার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, রয়েছে তার বক্তব্যের, চিন্তার প্রভাবও। ফলে তার কণ্ঠরোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাধাপদ সাধুসঙ্গ করেন বলে জানা গেছে। সাধু এবং বাউল ফকিরদের সৃষ্টিকর্তা ও ধর্ম সম্পর্কে বোঝাপড়া প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে যায় না। তারা রিলিজিয়াস নয় বরং স্পিরিচুয়াল যাপনে বিশ্বাসী হন। রাধাপদর কবিতায়ও তার নমুনা স্পষ্ট। হিন্দু বলে যাকে পেটানো হলো, তার ভার্সে দেখা যাচ্ছে কেয়ামতের উল্লেখ। সাধারণভাবে কেয়ামতের ধারণা লালন করেন মুসলিমরা। কিন্তু কবিদেরও সাধুদের মতো কোনো একক ধর্মের অনুসারী না হলেও চলে। তারা স্রষ্টার সাধনা করেন, অনুসন্ধান করেন শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে। সুতরাং জন্মগতভাবে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান যে পরিচয়ই থাকুক, তা তাদের লেখার মধ্যে মুখ্য হয়ে ওঠে না। প্রধান হয়ে ওঠে লেখার ভাব, কবিতার মধ্যে থাকা গভীর অর্থটা।
আমাদের দেশে আমরা ক্রমেই সব ধরনের বৈচিত্র্য হারিয়ে একরৈখিক ও একচ্ছত্র আদর্শায়িত এক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে এগিয়ে চলছি যা ভীষণ ভীতিকর। কবি রাধাপদ রায়ের ওপর এই হামলা যদি ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেও হয়ে থাকে, তারপরও তার কবিত্ব এবং জন্মগত হিন্দু পরিচয় এই ঘটনাকে আলাদা মাত্রা দেয়। গান করা, কবিতা লেখা ও হিন্দু নাম তাকে বিশেষভাবে ভালনারেবল করে। আক্রমণকারীরা মনেই করে একজন ‘সংখ্যালঘু’ বা ‘চারণ কবি’র কোনো ক্ষমতা নেই, তাকে পেটানোই যায়। ক্ষমতা কাঠামো তাকে রক্ষা করতে আসবে না কারণ তিনি ক্ষমতা কাঠামোকেও করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাস বলে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রচিন্তায় কবিদের কোনো স্থান ছিল না। কবিত্বকে সে সময় মনে করা হতো কোনো দৈবশক্তি, কবিদের মনে করা হতো দৈব ক্ষমতার অধিকারী মানুষ যারা কিনা সাধারণ যুক্তিবুদ্ধির ওপরে। ফলে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্যাণের পক্ষে তারা বাধা। প্লেটোর এই মতামত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নীতিনির্ধারকরা খুব যে মেনে চলেন তা হয়তো নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কলম ধরে নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাস যুগে যুগেই রচিত হয়েছে। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকাকে তুলে নিয়ে গুম খুন করবার ইতিহাস সবারই জানা। এ নিয়ে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতাও রয়েছে। চমৎকার দৃশ্যকল্প তৈরি করা মর্মস্পর্শী এই কবিতার শেষ লাইন হচ্ছে, ‘বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শেকলে বাঁধা থাকবে না!’
কবিদের হাত যে বাঁধা যায় না, তা হয়তো ক্ষমতা নিজেও জানে। সে কারণেই বারবার আঘাত হানে কবি ও শিল্পীদের ওপরই। আপাত নিরীহ কবিতায় থাকে নিপীড়নের বিরুদ্ধাচরণ করার শ্লোক, সময় সময় গানই হয়ে ওঠে স্লোগান। বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়াতেই চলছে লেখক ও সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার পাঁয়তারা, কবিদেরও অচিরেই এই মিছিলে শামিল হতে হবে বলে মনে হচ্ছে। অন্তত রাধাপদর মতো একজন অশীতিপর কবির শরীরে এমন নৃশংস আঘাত আর রক্তজবার মতো ক্ষত, এই ইশারাই দেয়। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া প্রয়োজন শুধু একজন কবির অবমাননার শাস্তি হিসেবে নয়, বরং এটা প্রমাণ করবার জন্য যে স্বাধীন একটি দেশের একজন কবিকে চাইলেই আঘাত করা যায় না। কবি রাধাপদর পিঠের রক্তজবার মতো ক্ষত সব কবির শরীরেই লেগেছে।
লেখক: কবি ও লেখক
ummerayhana@gmail.com