সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০২:৪৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও সংকটের ভূ-রাজনীতি

শাহাদাৎ হোসাইন:

গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে আলোচিত ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু ছিল আরব-ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্ক। সৌদি আরব ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদানসহ বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করেছে। সম্প্রতি সৌদি আরবের ডিফেক্টো লিডার মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সৌদি- ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্ক সময়ের ব্যাপার মাত্র’।

এসব তৎপরতা মূলত ভূমধ্যসাগর অভিমুখে কানেক্টিভিটি ও বাণিজ্য স্বার্থ, ইরানের সামরিক উত্থানকে ভারসাম্যের মধ্যে আনা, আরব দেশগুলোর নিজেদের নিরাপদ করা এবং মধ্যপ্রাচ্যকে ‘ইউরোপ’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস। ভাবা হচ্ছিল এসব তৎপরতার ফলে আরবরা ইসরায়েলের কাছে ‘পরাজয়’ স্বীকার করে ইসরায়েলকে ‘বাস্তবতা’ হিসেবে মেনে নিয়েছে। সেই সঙ্গে স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্নকে পশ্চিমাদের কাছে ‘বিক্রি’ করে দিয়েছে।

কিন্তু অবরুদ্ধ গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের অতর্কিত হামলা ও হামলার ফলে ইসরায়েলের দৃশ্যমান অপ্রস্তুত চেহারা এসব ধারণাকে আঘাত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বের কাছে ইসরায়েলকে বিনিয়োগের উৎকৃষ্ট জায়গা এবং তেল আবিবকে পর্যটকদের একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা গেছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে কাছে টানার কৌশলও নিয়েছিল দেশটি। ইসরায়েলের অবকাঠামো ও প্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ চলতি বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বর্তমানে অন্তত ১৮ হাজার ভারতীয় দেশটিতে কাজ করে। হামাসের হামলা ইসরায়েলকে অনিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবেই বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরবে।

এই হামলার পরিণতি এবং প্রতিক্রিয়া খুব ছোট হবে সেটা ভাবার সুযোগ নেই এবং খুব দ্রুত সমাধানও আশাতীত। কিন্তু এই হামলার মধ্য দিয়ে হামাস আরব রাষ্ট্রগুলোর কাছে এই বার্তা দিতে পেরেছে যেÑ ‘তোমরা যাকে বাস্তবতা ভেবে কূটনৈতিকভাবে মেনে নিচ্ছো আমরা তাকে ২০ মিনিটে এলোমেলো করে দিতে পারি।’

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ : আরব-ইসরায়েল যুদ্ধকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সংঘাত বা যুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে হবে না। এমনকি শুধুমাত্র রাষ্ট্রশক্তির অবস্থান দিয়েও এই সংঘাতকে বোঝা যাবে না। জেরুজালেম মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। ফলে এখানকার এই সংঘাত কেবল রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ নয় এটি ধর্মেরও যুদ্ধ। এর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদ অবধারিতভাবে জড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্র শক্তির বাইরে এই সংঘাতে শতাব্দীর পর শতাব্দী অ-রাষ্ট্রীয় শক্তি, রাষ্ট্রীয় জোট, সাম্রাজ্য যুদ্ধ করেছে। এই ইস্যুতে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদল হয়নি এমনকি নিকট অতীতে অনেক প্রভাবশালী দেশের রাজনৈতিক সরকারের পতনও হয়েছে। মানব ইতিহাসের বুকে সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য এসেছে। রোমান সাম্রাজ্য থেকে অটোমান সাম্রাজ্য সব সাম্রাজ্যের ভিশন ছিল জেরুজালেম নিয়ে, আল-আকসাকে নিয়ে। ধর্ম ও রাজনীতির বাইরেও ভূমধ্যসাগরের তীরের এই ভূ-খন্ডটির বাণিজ্যিক ও পূর্ব-পশ্চিম যোগাযোগ তৈরির গুরুত্ব রয়েছে। ফলে বিশ্ব মোড়ল হিসেবে আগে ব্রিটিশরা বর্তমানে আমেরিকানরা অঞ্চলটির ওপর কর্র্তৃত্ব বজায় রাখতে মরিয়া।

যদি আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর শুরু থেকে ফিলিস্তিনের ইতিহাস ধরা হয়, তাহলে এই ইতিহাস ফিলিস্তিনের বঞ্চিত ও প্রতারিত হওয়ার ইতিহাস। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, এখন পশ্চিম তীরের (ফিলিস্তিন) ৬০ শতাংশ এলাকা সম্পূর্ণ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। পূর্ব জেরুজালেমে ৩৫ শতাংশ এলাকাজুডে অবৈধ ইহুদি ইসরায়েলি বসতি। অধিকৃত ফিলিস্তিনে ৬ লাখেরও বেশি ইহুদি ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করছে। ১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে ১ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি ইসরায়েল দখল করেছে। গত ৫০ বছরে ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি বাড়ি ও স্থাপনা ইসরায়েল ধ্বংস করেছে।

যেভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হলো : অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর লিগ অব নেশন-এর পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ‘ম্যান্ডেট’ দেওয়া হয় ফিলিস্তিন শাসন করার। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলটি তখন ফিলিস্তিনি আর ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল। পরদিনই মিসর, জর্দান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলে। কিন্তু অভিযানে ইসরায়েল ফিলিস্তিনসহ আরব দেশগুলোর বৃহৎ অঞ্চল দখল করে নেয়। সে থেকে ফিলিস্তিনিরা ১৫ মে’কে ‘নকবা দিবস’ বা বিপর্যয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৬৭ সালে ফের যুদ্ধে জড়ায় দুই পক্ষ যা ইতিহাসে ‘ছয়দিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত, এই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্যাপক প্রভাব রেখেছিল। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের ‘ভূমি পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে’ একদিকে ছিল মিসর আর সিরিয়া, অন্যপক্ষে ইসরায়েল। মিসর এই যুদ্ধে সিনাই অঞ্চলে তাদের কিছু হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করতে পারলেও গাজা বা গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলকে হটানো যায়নি। তবে ১৯৯৪ সালে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক চাপে গাজাকে ফিলিস্তিনের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। সেখানে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড় ধরনের লড়াই হয় ২০০৮, ২০০৯, ২০১২ এবং ২০১৪ , ২০১৮ (জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায়) এবং ২০২১ সালে। তবে এবারের সংঘাত বা যুদ্ধ আগের যেকোনো মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ৯০০ ইসরায়েলি নিহত, ১৫০ বন্দি ও ২ হাজার ৫০০ জন আহতের খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের উপর্যুপরি বোমা হামলায় গাজায় ৬৮০ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ২ হাজার জন আহতের খবর এসেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ১২ ঘণ্টার মধ্যে গাজা দখলের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন তারা। তবে তাদের সে গাজা অভিযান অত সহজ হবে না। হামাসের সহমর্মী হিজবুল্লাহ ইতিমধ্যে হামাসের পক্ষ থাকার ঘোষণা দিয়েছে।

ইসরায়েল গাজা অভিমুখে স্থল অভিযানে গেলে হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে হামলা আসতে পারে। সেই সঙ্গে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরেও। ইসরায়েল যদি স্থল অভিযানে যায় গাজায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিরা নির্বিচারে হত্যার সম্মুখীন হবে। সেখানে আটক ইসরায়েলিরা মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে গাজায় অভিযান ব্যাপক মাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে আসবে। তবে এটা নিশ্চিত ইসরায়েলের গাজা অভিযান তীব্র ফিলিস্তিনি সামরিক-বেসামরিক প্রতিরোধের মুখে পড়বে।

গাজায় সম্প্রতি যে বিক্ষোভ দেখা গেছে তা সেখানে ধূমায়িত হতে থাকা ক্ষোভ এবং হতাশার বহিঃপ্রকাশ। কারণ শান্তি প্রক্রিয়ার অকার্যকারিতায় ব্যাপকভাবে হতাশ ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনিরা চায় ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগে যে সীমান্ত ছিল, সেই সীমানার ভিত্তিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে। ইসরায়েলিরা তা মানতে নারাজ। ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের স্বপ্নের দেশের রাজধানী হিসেবে ভাবে, অন্যদিকে ইসরায়েল জোরপূর্বক পুরো জেরুজালেমকে দখল করে রেখেছে, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে জোর করে অবৈধ বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে গাজার ওপর জারি করেছে অবরোধ। গাজায় বর্তমানে জরুরি খাদ্য সহায়তা এমনকি চিকিৎসা সহায়তা অপ্রতুল। অঞ্চলটির ৬০ শতাংশের অধিক তরুণ বেকার। তাদের মধ্যে জমা রয়েছে তীব্র ক্ষোভ।

১৯৬৭ সালের স্থিতাবস্থা অনুসারে, আল-আকসায় শুধুমাত্র মুসলমানদের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু প্রায়শই ইসরায়েলি পুলিশ আল-আকসার ভেতরে প্রবেশ করে নারী-পুরুষ এমনকি শিশুদের ওপর হামলা করেছে। ২০১৭ সাল থেকে আল-আকসা প্রাঙ্গণে প্রার্থনাকারী ইহুদিদেরও প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আল-আকসার পবিত্রতাকে ভূ-লুণ্ঠিত করাও এবারের বিক্ষোভের অন্যতম কারণ। হামাস অভিযানের নাম দিয়েছেÑ ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’।

ফিলিস্তিনিরা এর আগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দুটি গণঅভ্যুত্থান বা ‘ইন্তিফাদা’ ঘটিয়েছে। প্রথমটি ১৯৮০’র দশকে। পরেরটি ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ৫ বছর। ১৯৮৭ সালের প্রথম ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনিরা ছিল কার্যত নিরস্ত্র। ফিলিস্তিনি তরুণ এবং কিশোররা পাথর ছুড়ে ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করছে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ছিল অনেক বেশি রক্তাক্ত। তিন হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয় সেই সময়। ইসরায়েলিদেরও হারাতে হয় এক হাজার সৈন্য। এবারের হামাসের আক্রমণটি ভাবা যেতে পারে তৃতীয় ইন্তিফাদা বা বিপ্লব হিসেবে। যদিও এখনো পর্যন্ত সে তৃতীয় বিপ্লব চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি। ইসরায়েলের গাজা অভিমুখে অভিযান এবং আল-আকসায় ‘অনুপ্রবেশের’ প্রতিক্রিয়ার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে হামাসের এই তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হতে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে হিজবুল্লাহ। অন্যদিকে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা তো পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িয়েই আছেন। ইসরায়েল গাজা অভিমুখে স্থল ও বিমান হামলা চালিয়ে গাজাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলতে পারে। তবে মনে হয় না তাতে হামাস ধ্বংস হয়ে যাবে। অথবা হামাস ধ্বংস হলেও ফিলিস্তিনি ভূ-খন্ডের ওপর ফিলিস্তিনের অধিকার চাপা পড়ে যাবে না। সে অধিকার কেউ না কেউ বাঁচিয়ে রাখবে। অসংখ্য যুদ্ধ, সহিংসতার পরও আল-আকসার ওপর মুসলমানদের অধিকারকে ভুলিয়ে ফেলা যায়নি। সব যুদ্ধ শেষে ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে যেমন নতুন পত্রপল্লবে বৃক্ষ গজিয়ে ওঠে আল-আকসার সোনালি গম্বুজ তেমনি যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

Shahadatju44@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION